গাজায় তিন দিনে ৬০০ প্রাণহানি, তেল আবিবে হামাসের পাল্টা রকেট নিক্ষেপ
গাজার আকাশে যেন মৃত্যু নৃত্য করছে। ইসরায়েলের তীব্র বিমান ও স্থল হামলায় রক্তাক্ত হচ্ছে অবরুদ্ধ উপত্যকাটি। গত তিন দিনে প্রাণ গেছে প্রায় ৬০০ ফিলিস্তিনির। এমন ভয়াবহ হামলার জবাবে ইসরায়েলের বাণিজ্যিক কেন্দ্র তেল আবিবে রকেট হামলা চালিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস। তারা বলছে, গাজার নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের ওপর চালানো ‘গণহত্যার’ প্রতিশোধ নিতেই এই হামলা।
বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলের চলমান আগ্রাসনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯ হাজার ৬১৭ জনে। এছাড়া আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১ লাখ ১২ হাজার ৯৫০ জন। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো অনেক মরদেহ আটকে রয়েছে। রাস্তায় পড়ে থাকা আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না উদ্ধারকারীরা। গাজা যেন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।
এদিকে, নতুন করে শুরু হওয়া ইসরায়েলের স্থল অভিযানে গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফাহ শহরও বিধ্বস্ত। বোমার আঘাতে সেখানে একের পর এক ভবন ধসে পড়ছে। পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন বাসিন্দারা। নুসাইরাত শরণার্থী শিবির থেকে সালাহেদ্দিন রোড ধরে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে অসংখ্য ফিলিস্তিনিকে।
গাজার বাসিন্দা মোহাম্মদ হুসেইন বলেন, “আমরা প্রতিরক্ষাহীন ফিলিস্তিনি। আমাদের ওপর যে গণহত্যা চলছে, তা বন্ধ করতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা যুদ্ধবিরতি চাই, শান্তি চাই।”
অন্যদিকে, তেল আবিবে রকেট হামলার দায় স্বীকার করেছে হামাসের সামরিক শাখা ইজেদাইন আল-কাশেম ব্রিগেডস। গোষ্ঠীটির দাবি, ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় নারী ও শিশুসহ অসংখ্য নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছেন। এরই প্রতিশোধ নিতে তারা ইসরায়েলের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্রে আঘাত হেনেছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, গাজা থেকে ছোড়া বেশ কয়েকটি রকেটের মধ্যে একটি মাঝপথেই ধ্বংস করা হয়েছে। বাকি দুটি রকেট জনবসতিহীন এলাকায় আঘাত হানে। ইসরায়েলের দাবি, এ ঘটনায় কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
কিন্তু বাস্তবতা বলছে, আকাশপথে চালানো ইসরায়েলের তাণ্ডবে গাজার পরিস্থিতি দিনকে দিন আরও শোচনীয় হচ্ছে। ফিলিস্তিনের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মুহূর্তেই। অনেক শিশুকে আহত অবস্থায় ধ্বংসস্তূপের নিচে কাঁদতে দেখা গেছে। চোখের সামনে প্রিয়জনদের মৃত্যু দেখেও কিছুই করতে পারছেন না ফিলিস্তিনিরা।
গাজায় চলমান এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পেছনে কূটনৈতিক অচলাবস্থাও বড় ভূমিকা রাখছে। জানুয়ারিতে ঘোষিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই উত্তেজনা তুঙ্গে ছিল। সেই চুক্তি নবায়নের ব্যাপারে একমত হতে না পারায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়েছে। হামাসের দাবি, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে। অপরদিকে ইসরায়েল অভিযোগ করছে, হামাসই চুক্তি ভঙ্গ করেছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছেন, “গাজা উপত্যকায় পুনরায় শুরু করা আমাদের স্থল অভিযান চলবে। যেকোনো মূল্যে হামাসকে নির্মূল করা হবে। আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হচ্ছি।”
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সহিংসতা কেবল মানবিক সংকটকেই আরও প্রকট করে তুলবে। ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণ এর ভয়াবহ মাশুল দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা এই সংকটকে আরও গভীর করে তুলছে।
ইউনিসেফ ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে ইসরায়েলকে হামলা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে তারা।
গাজায় চলমান এই আগ্রাসনের ফলে খাদ্য, পানি ও ওষুধের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রী নেই। আহতদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এদিকে, মুসলিম বিশ্বে ইসরায়েলের এই হামলার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ চলছে। কায়রো, তেহরান, জাকার্তা ও কুয়ালালামপুরসহ বিভিন্ন শহরে হাজারো মানুষ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে তারা ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধের আহ্বান জানান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজায় ইসরায়েলের চলমান হামলা কেবল আঞ্চলিক উত্তেজনাকেই বাড়াবে। হামাসের পাল্টা আঘাতের সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি প্রতিবেশী দেশগুলোও এই সংঘাতের জেরে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা নতুন মাত্রা নিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
গাজার আকাশে এখনো উড়ছে ধোঁয়া। শিশুর কান্না, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মানুষের আর্তনাদ—সব মিলিয়ে গাজা এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে বিশ্ব, তবে সেই আহ্বান ইসরায়েল ও হামাসের কানে পৌঁছাবে কি না, সেটিই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।