শুক্রবার, ৬ই জুন, ২০২৫| সন্ধ্যা ৭:৫৮

আন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটে কালোটাকা বৈধতার সুযোগে তীব্র সমালোচনা

প্রতিবেদক
staffreporter
জুন ৪, ২০২৫ ৭:৪৮ পূর্বাহ্ণ
আন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটে কালোটাকা বৈধতার সুযোগে তীব্র সমালোচনা

আন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটে কালোটাকা বৈধতার সুযোগে তীব্র সমালোচনা

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র ১০ মাসের মাথায় কালোটাকা সাদা করার সুবিধা পুনর্বহাল করায় দেশজুড়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনকালে জানান, নির্দিষ্ট হারে কর পরিশোধের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ থাকছে এবারও। অর্থাৎ, পূর্ববর্তী সরকারের বিতর্কিত সুবিধাটিই মূলত বহাল রাখছে বর্তমান সরকার।

এই ঘোষণার পরপরই নাগরিক সমাজ, অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের কড়া প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একে দুর্নীতিবান্ধব এবং কর ন্যায়বিচারের পরিপন্থী বলে অভিহিত করে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানায়, এটি ‘জুলাই আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’ সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন জানান, এমন নীতি বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণের আদর্শের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, এতে সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে এবং সমাজে বৈষম্য আরও বাড়বে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান অভিযোগ করেন, সরকার দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে রিয়েল এস্টেট লবির কাছে নতিস্বীকার করেছে। সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অনুপার্জিত আয় বৈধ করা যায় না, অথচ এই বাজেটে সেই পথ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। টিআইবির গবেষণায় দেখা যায়, দেশে কালোটাকার পরিমাণ জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে, যার প্রকৃত অঙ্ক ১০ থেকে ১২ লাখ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। অথচ এ পর্যন্ত মাত্র ৪৭ হাজার কোটি টাকার মতো কালো টাকা সাদা করা হয়েছে, যা সামান্য একটি অংশ।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকার এনবিআরের মাধ্যমে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার বিধান বাতিল করেছিল। তখন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, কালোটাকা বৈধতার সুযোগ আর থাকবে না। তবে ১০ মাস পর সেই অবস্থান থেকে সরে এসে বাজেটে ফের এই সুযোগ রাখা হলো, যদিও এবার কিছু শর্ত সংযুক্ত করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোর নির্দিষ্ট সাইজের বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ বা কেনার ক্ষেত্রে নির্ধারিত হারে কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করা যাবে। উদাহরণস্বরূপ, গুলশান বা বনানীতে দুই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনলে ৪০ লাখ টাকা কর দিতে হবে। তবে ওই অর্থ যদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা অবৈধ উৎস থেকে আসে, তাহলে সে সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। পাশাপাশি আগের কিছু বিশেষ ছাড়, যেমন একাধিক বিল্ডিং বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মাণে কর ছাড়, তা বাতিল করা হয়েছে।

তবে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা কোনো ‘ঢালাও সুযোগ’ নয় বরং সীমিত পরিসরে নির্দিষ্ট খাতে কর দিয়ে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা। সরকারের ভাবমূর্তি নিয়ে সমালোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খানও দাবি করেন, আগের বছরের মতো কোনো বিশেষ স্কিম চালু হয়নি। তবে যারা জমি বা ফ্ল্যাট কিনতে চান, তারা অতিরিক্ত কর দিয়ে সেটা বৈধ করতে পারবেন। এটি মূলত অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যবহারের সীমিত পথ মাত্র।

অর্থনীতিবিদদের অনেকে মনে করছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সরকারের জন্য এটি একটি বড় ধরনের নৈতিক পরাজয়। অনেকে এটিকে রাজনৈতিক সমঝোতা ও ভবিষ্যৎ নির্বাচনের কৌশল হিসেবেও দেখছেন। কেউ কেউ বলেন, সরকার পুঁজি বাজার ও আবাসন খাত চাঙা করতে চাইছে, যেখানে অতীতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ ছিল।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের সিদ্ধান্ত দেশের কর ন্যায্যতা ও নৈতিকতার ভিত্তিকে দুর্বল করে এবং স্বচ্ছতার প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তিতে ধাক্কা দেয়। কালোটাকা সাদা করার সুবিধা চালু থাকলে একদিকে দুর্নীতি উৎসাহিত হবে, অন্যদিকে নিয়মিত করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন— যা অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।

মন্তব্য করুন
Spread the love

সর্বশেষ - বানিজ্য ও অর্থনীতি