গাজা, লেবানন ও সিরিয়ায় সেনা মোতায়েন স্থায়ী করতে চায় ইসরায়েল— মানবিক সাহায্যেও নিষেধাজ্ঞা
গাজা, লেবানন ও সিরিয়ার দখলকৃত অংশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সেনা অবস্থান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। এই সিদ্ধান্তের পেছনে নিরাপত্তা ও কৌশলগত নিয়ন্ত্রণকে কারণ হিসেবে দেখাচ্ছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
বুধবার এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাভটজ জানান, এখন থেকে আর আগের মতো দখলকৃত অঞ্চলগুলো থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। বরং গাজা, লেবানন এবং সিরিয়ার সীমান্তজুড়ে তারা ‘বাফার জোন’ গঠন করে সেখানে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে সেনা মোতায়েন রাখবে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গাজার প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা ইতোমধ্যেই তারা ‘নিরাপদ বাফার জোন’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ১৮ মার্চ শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতির পর ফের অভিযান চালিয়ে ইসরায়েলি বাহিনী এখন পর্যন্ত প্রায় ১,২০০ ‘লক্ষ্যবস্তু’তে হামলা চালিয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
গাজায় হামাস-বিরোধী অভিযান এবং মানবিক সংকট
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আবারো ঘোষণা করেছেন, তিনি হামাসকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করবেন এবং গাজায় আটক ৫৯ জন ইসরায়েলি বন্দিকে উদ্ধার করবেন। তাদের মধ্যে ২৪ জনকে এখনও জীবিত বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী সম্পূর্ণভাবে না সরলে এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির নিশ্চয়তা না দিলে তারা কোনো বন্দি মুক্তি দেবে না।
বন্দিদের পরিবারগুলোর পক্ষ থেকেও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। তারা ইসরায়েলি সরকারকে অভিযুক্ত করেছে যে, বন্দিদের মুক্তির চেয়ে দখল ও আগ্রাসনকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
এদিকে, ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ বুধবার এক ইসরায়েলি বন্দি রোম ব্রাসলাভস্কির ভিডিও প্রকাশ করেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, বন্দিটি শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং তিনি নেতানিয়াহুকে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছেন।
মানবিক সহায়তায় কড়াকড়ি, জাতিসংঘের নিন্দা
গাজার ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতির মধ্যেই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাভটজ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, এখন থেকে গাজায় কোনো ধরনের মানবিক সাহায্য প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
এক্স-এ (প্রাক্তন টুইটার) প্রকাশিত বিবৃতিতে কাভটজ বলেন, “গাজায় কোনো সাহায্য প্রবেশের প্রস্তুতিও নেই এবং আমাদের নীতি একেবারে স্পষ্ট—গাজা এখন সহায়তাবিহীন।”
ইসরায়েলের সংস্কৃতি মন্ত্রী মিকি জোহার আরও কড়া ভাষায় বলেছেন, “গাজার জঘন্য খুনিদের কোনো মানবিক সাহায্য প্রাপ্য নয়—বেসামরিক বা সামরিক, কোনো কিছুতেই না। যতদিন শেষ বন্দি ফেরত না আসে, ততদিন সন্ত্রাসীদের ওপর নরকের আগুন বর্ষণ চলবে।”
ইতিমধ্যেই ছয় সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে গাজায় সব ধরনের সাহায্য প্রবেশ বন্ধ রেখেছে ইসরায়েল। এর ফলে সেখানকার মানবিক পরিস্থিতি চরমে পৌঁছেছে।
জাতিসংঘ এই পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করেছে। ইসরায়েলের প্রস্তাবিত নতুন অনুমোদন ব্যবস্থাও প্রত্যাখ্যান করেছে তারা। জাতিসংঘ জানায়, সাহায্য পৌঁছানো নিয়ন্ত্রণে নতুন কোনো কাঠামো প্রয়োজন নেই, কারণ তাদের নিজস্ব স্বচ্ছ প্রক্রিয়া রয়েছে যা নিশ্চিত করে— সহায়তা হামাসের হাতে না পড়ে।
গাজা ও লেবাননে চলমান হামলা
চিকিৎসা সূত্র জানায়, বুধবার ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজার বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৩৫ জন নিহত হয়েছেন। গাজা সিটির এক হামলায় নিহত হন ফিলিস্তিনি নারী সাংবাদিক ফাতিমা হাসসুনেহ এবং তার পরিবারের ১০ সদস্য।
অন্যদিকে লেবাননের পরিস্থিতিও অশান্ত। লেবাননের প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউন জানিয়েছেন, দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলি সেনার স্থায়ী উপস্থিতির কারণে লেবানন সেনাবাহিনীর মোতায়েনে বাধা তৈরি হচ্ছে।
যদিও নভেম্বর মাসে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে উভয় দেশই সেনা প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছিল, তবু ইসরায়েল এখনও পাঁচটি স্থানে সেনা রেখে গেছে।
লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় বুধবার দক্ষিণ লেবাননে দুজন নিহত হয়েছেন। যুদ্ধবিরতির পর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় সেখানে প্রাণ হারিয়েছেন ৭০ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক।
সিরিয়াতেও ইসরায়েলি প্রভাব বিস্তার
সিরিয়ার ভেতরেও একাধিক সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে ইসরায়েল। বিশেষ করে হারমোন পাহাড়ের চূড়ায় তারা বর্তমানে অবস্থান করছে।
ইসরায়েল বলছে, বর্তমান ‘সিরিয়ার সরকার’ আসলে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর নেতৃত্বে গঠিত, যেটিকে তারা ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই পরিস্থিতিতে দখলকৃত অঞ্চলগুলো থেকে সেনা প্রত্যাহার তারা অস্বীকার করেছে।
গাজা, লেবানন ও সিরিয়া— তিন অঞ্চলেই ইসরায়েলের এ ধরণের দীর্ঘমেয়াদী সেনা অবস্থান ও মানবিক সহায়তা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা আরও বিপন্ন করে তুলছে। আন্তর্জাতিক মহল গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, এখনো কূটনৈতিক সমাধান দেখা যাচ্ছে না— বরং সংঘাতের আগুন আরও দাউদাউ করে জ্বলছে।