৯ মামলার আসামি এক মুক্তিযোদ্ধা ‘জুতার মালা’য় হিরো!
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গত রোববার ৭৮ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই ওরফে কানুকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে অপমান করার একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, কানু কোন প্রতিবাদ না করে দুঃখের সঙ্গে শাস্তি মেনে নিচ্ছেন, এবং তার গলায় জুতার মালা পরিয়ে তাকে এলাকা ছাড়ার জন্য বলা হচ্ছে।
আবদুল হাই, যিনি কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার সাবেক সহসভাপতি, তাকে এলাকার লোকজন নানা অভিযোগে জুলুম নির্যাতনের জন্য চিহ্নিত করে। তার বিরুদ্ধে হত্যা, নির্যাতনসহ ৯টি মামলা রয়েছে। তিনি এক সময় চৌদ্দগ্রামের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং বহু বছর ধরে প্রতিপক্ষের ওপর অত্যাচার চালানোর অভিযোগ রয়েছে। বিশেষত, আওয়ামী লীগের বিপক্ষে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের তিনি এলাকায় নির্যাতন ও তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। কিছু গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশ হওয়ার সময় আবদুল হাইয়ের নামের আগে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হেনস্তা হওয়া উচিত নয়, তবে তার অতীত কর্মকাণ্ডের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
ভুক্তভোগী আবদুল হাই কানুর পরিবার জানিয়েছে, এই ঘটনা ঘটানোর পেছনে স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের হাত রয়েছে। পরিবার দাবী করেছে, একদিকে তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগও রয়েছে। ইতোমধ্যে, কানু অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ফেনী শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এদিকে, চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জামায়াতের নেতারা ঘটনাটি মেনে নেওয়ার মতো বলে মন্তব্য করেছেন, তবে তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। পুলিশ প্রশাসন জানিয়েছে, ভিডিওটি দেখে তারা সন্দেহভাজনদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করতে শুরু করেছে এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চৌদ্দগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ টি এম আক্তার উজ জামান জানিয়েছেন, তিনি কানু ও তার পরিবারের সাথে দুইবার কথা বলেছেন। তবে কানু কোনো অভিযোগ করতে রাজি হননি এবং তার মতে অভিযোগ করলে এলাকায় থাকা সম্ভব হবে না। তবুও, তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনকে দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে। তবে সরকার মুখ খুলে না থাকলেও, তাদের বক্তব্যের মধ্যে একধরনের সমর্থন প্রতিফলিত হয়েছে, কারণ একাধিক মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানিত করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন, “মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে তিনি কি অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না?” তাঁদের মতে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং ক্ষমতার দাপটে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আজকাল অন্যায় করেছেন, যা দেশের সুরক্ষা ও মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
তবে এটি নিশ্চিত যে, এ ঘটনার মাধ্যমে সমাজে রাজনৈতিক প্রতিশোধস্পৃহা এবং ব্যক্তিগত শত্রুতা কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা আরেকবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।