গাজায় নতুন করে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস গাজায় নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মতি দিয়েছে। এই প্রস্তাব এসেছে মিশর এবং কাতারের মধ্যস্থতায়, যারা দীর্ঘদিন ধরে এই সংঘাতে শান্তি ফেরানোর চেষ্টা করে আসছে। হামাসের প্রধান নেতা খলিল আল-হায়া শনিবার এই খবরটি নিশ্চিত করেছেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্স তাদের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করেছে। এই ঘোষণা গাজার মানুষের জন্য একটি আশার আলো জ্বালতে পারে, যারা গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
টেলিভিশনে দেওয়া এক আবেগঘন বক্তব্যে খলিল আল-হায়া বলেছেন, “দুই দিন আগে আমরা মিশর ও কাতারের কাছ থেকে একটি প্রস্তাব পেয়েছি। আমরা এটিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছি।” তিনি এই প্রস্তাবের বিস্তারিত খোলাসা না করলেও এর মাধ্যমে যুদ্ধ থামানোর সম্ভাবনা দেখছেন। তিনি আরও যোগ করেছেন, “আমরা আশা করি, ইসরায়েল এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে না। আমাদের লক্ষ্য গাজার মানুষের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা।” খলিল আল-হায়া ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। তার এই ঘোষণা অনেকের কাছে একটি সমঝোতার দিকে এগোনোর ইঙ্গিত।
গত ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে হামলার মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ শুরু হয়। হামাসের সেই আক্রমণে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করা হয়। এর জবাবে ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে, যা এখনো চলছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত ৪৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এছাড়া, গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার মধ্যে প্রায় ১৮ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য বারবার আলোচনা হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই তা ভেস্তে গেছে।
মিশর ও কাতার এই সংঘাতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে তাদের মাধ্যমে একটি সাত দিনের যুদ্ধবিরতি হয়েছিল, যার সময় ১০০ জনের বেশি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং গাজায় সাহায্য পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু তারপর থেকে আলোচনাগুলো বারবার বাধার মুখে পড়েছে। ইসরায়েলের দাবি ছিল, হামাসকে পুরোপুরি নির্মূল না করা পর্যন্ত তারা থামবে না। অন্যদিকে, হামাস বলে আসছিল, তারা জিম্মিদের মুক্তি দেবে শুধু যদি গাজার ওপর থেকে ইসরায়েলি অবরোধ তুলে নেওয়া হয় এবং সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়। এই দুই পক্ষের কঠোর অবস্থানের কারণে শান্তি প্রক্রিয়া এতদিন এগোয়নি।
নতুন এই প্রস্তাবে ঠিক কী আছে, তা এখনো পুরোপুরি প্রকাশ করা হয়নি। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, এতে জিম্মি মুক্তি, গাজায় ত্রাণ সরবরাহ এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যুদ্ধবিরতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। হামাসের এই ইতিবাচক সাড়া এই অঞ্চলে শান্তি ফেরানোর একটি সম্ভাবনা তৈরি করেছে। খলিল আল-হায়া বলেছেন, “আমরা আমাদের জনগণের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। গাজার মানুষ এই যুদ্ধে অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমরা এই ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
ইসরায়েল এখনো এই প্রস্তাবের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে, “আমরা প্রস্তাবটি পরীক্ষা করে দেখছি। আমাদের নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থ সবার আগে।” ইসরায়েলের অতীতের অবস্থান বিবেচনা করলে অনেকে আশঙ্কা করছেন, তারা এই প্রস্তাবে পুরোপুরি সম্মতি না দিতে পারে। নেতানিয়াহু বারবার বলে এসেছেন, “হামাসকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করাই আমাদের লক্ষ্য।” তবে গাজায় চলমান মানবিক সংকট এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তারা শান্তির প্রস্তাবে সাড়া দিতে বাধ্য হতে পারে।
মিশর ও কাতারের মধ্যস্থতাকারীরা এই চুক্তি বাস্তবায়নে তৎপর রয়েছে। মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা আশাবাদী যে এই প্রস্তাব দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা আনবে। গাজার মানুষের কষ্ট আর বাড়ানো উচিত নয়।” কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান আল থানি বলেছেন, “এটি একটি সুযোগ, যা আমাদের হাতছাড়া করা উচিত নয়।”
গাজার সাধারণ মানুষ এই খবরে কিছুটা আশার আলো দেখছেন। গাজা সিটির বাসিন্দা আহমেদ আলি বলেছেন, “আমরা আর যুদ্ধ চাই না। আমাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে, পরিবার হারিয়েছি। শান্তি হলে আমরা আবার জীবন শুরু করতে পারব।” তবে অনেকে আশঙ্কায় রয়েছেন যে, এই চুক্তিও আগের মতো ভেঙে পড়তে পারে।
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে হামাসের এই সম্মতি গাজার জন্য একটি বড় পদক্ষেপ। এখন সবার নজর ইসরায়েলের দিকে। তারা কী সিদ্ধান্ত নেয়, তার ওপরই নির্ভর করছে এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ। গত দেড় বছরে গাজায় যে ধ্বংস হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে এই চুক্তি একটি সুযোগ হতে পারে। কিন্তু শান্তি স্থায়ী হবে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।