গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৪০, লেবাননে প্রাণ গেল আরও ৬ জনের
গাজা ও লেবাননে ইসরায়েলি হামলার তাণ্ডব আবারও অনেকগুলো প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। গতকাল, ২৭ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলায় কমপক্ষে ৪০ জন নিহত হয়েছেন। একই সময়ে লেবাননের পূর্বাঞ্চলে হামলায় আরও ৬ জনের জীবন ঝরে গেছে। এই ঘটনা শুধু সংখ্যার হিসেব নয়, এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য পরিবারের কান্না, হাহাকার আর হারানোর বেদনা।
গাজার উত্তরাঞ্চলের জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে গতকাল রাতে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী তাদের হামলার তীব্রতা বাড়ায়। স্থানীয় সূত্র জানাচ্ছে, রাতের আঁধারে হঠাৎ শুরু হয় বোমার শব্দ। একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। হামাস-নিয়ন্ত্রিত আল-আকসা টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, এই হামলায় ৪০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, “আমরা এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মরদেহ উদ্ধার করছি। অনেকে এখনো নিখোঁজ।”
জাবালিয়ার একজন বাসিন্দা, আহমেদ আল-নাজ্জার, যিনি তার পরিবারের তিন সদস্যকে হারিয়েছেন, তিনি বলেন, “আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ একটা বিস্ফোরণে সব শেষ হয়ে গেল। আমার ছোট্ট মেয়েটা আর নেই।” এই হামলায় বেশ কয়েকটি তাঁবু ও অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, আগুনের লেলিহান শিখা আর ধোঁয়ার কারণে অনেকে পালাতে পারেননি। হাসপাতালগুলোতে আহতদের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নেই। চিকিৎসকরা বলছেন, ওষুধ আর সরঞ্জামের অভাবে তারা অসহায় বোধ করছেন।
একই সময়ে লেবাননের পূর্বাঞ্চলের বেকা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলায় ৬ জন নিহত হয়েছেন। লেবাননের স্থানীয় গণমাধ্যম জানাচ্ছে, এই হামলার লক্ষ্য ছিল হিজবুল্লাহর একটি সামরিক ঘাঁটি। নিহতদের মধ্যে দুজন হিজবুল্লাহর সদস্য, বাকিরা বেসামরিক নাগরিক। হিজবুল্লাহর একজন মুখপাত্র বলেন, “ইসরায়েল আমাদের যোদ্ধাদের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও টার্গেট করছে। এর জবাব আমরা দেব।”
বেকা উপত্যকার একজন প্রত্যক্ষদর্শী, ফাতিমা হাসান, জানান, “আমরা বাড়িতে বসে ছিলাম। হঠাৎ একটা জোরালো শব্দ হলো। জানালা দিয়ে দেখি, আকাশে আগুনের গোলা। আমার প্রতিবেশী পরিবারের দুজন আর নেই।” এই হামলায় বেশ কয়েকটি বাড়ি ও একটি গুদামঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। তাদের দাবি, গাজায় হামাস এবং লেবাননে হিজবুল্লাহর সামরিক ঘাঁটিগুলোই ছিল তাদের লক্ষ্য। একজন সামরিক মুখপাত্র বলেন, “আমরা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি। গত ৭ অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের হামলার পর থেকে আমরা তাদের ক্ষমতা ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর।” ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেছেন, “আমাদের শত্রুদের শিকড় থেকে উৎপাটন না করা পর্যন্ত আমরা থামব না।”
ইসরায়েলের দাবি, তারা বেসামরিক মৃত্যু এড়াতে চেষ্টা করছে। কিন্তু গাজা ও লেবাননের স্থানীয়রা বলছেন, এই হামলায় বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নিরীহ মানুষ। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ১৮ মার্চ থেকে শুরু হওয়া সাম্প্রতিক হামলায় ৮৩০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে নারী ও শিশুদের সংখ্যাই বেশি।
হামাস এই হামলাকে “গণহত্যা” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। গোষ্ঠীটির একজন নেতা বলেন, “ইসরায়েল আমাদের নেতৃত্বকে দুর্বল করতে চায়। কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ব।” তারা জানিয়েছে, এই হামলার জবাবে তারা ইসরায়েলের দিকে রকেট ছুড়তে পারে। অন্যদিকে, হিজবুল্লাহও প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে। তাদের একটি বিবৃতিতে বলা হয়, “ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের মূল্য তাদের দিতে হবে। আমরা আমাদের জনগণকে রক্ষা করব।”
এই হামলার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র ফারহান হক বলেন, “গাজা ও লেবাননে বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। উভয় পক্ষকে সংযম দেখাতে হবে।” মিশর এই হামলাকে “যুদ্ধবিরতি চুক্তির লঙ্ঘন” হিসেবে অভিহিত করে অবিলম্বে হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি, যদিও তারা ইসরায়েলের “আত্মরক্ষার অধিকার” সমর্থন করে আসছে।
গাজায় এই হামলার ফলে মানবিক সংকট আরও গভীর হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গত দেড় বছরে গাজায় ৫০,০০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত। খাদ্য, পানি, ওষুধের অভাবে সেখানকার জনজীবন বিপর্যস্ত। একজন ত্রাণকর্মী বলেন, “আমরা যা দেখছি, তা অকল্পনীয়। শিশুরা না খেয়ে কাঁদছে, হাসপাতালে পা ফেলার জায়গা নেই।” এদিকে লেবাননেও একই অবস্থা। বেকা উপত্যকায় হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।
অন্যদিকে গাজায় চলমান সংঘাতে জিম্মিদের ভাগ্য নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ২৫০ জনের বেশি ইসরায়েলি ও বিদেশি নাগরিককে জিম্মি করেছিল। হামাস জানিয়েছে, ইসরায়েল যদি জোর করে জিম্মিদের উদ্ধারের চেষ্টা করে, তবে তাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। একজন জিম্মির পরিবারের সদস্য বলেন, “আমরা শুধু চাই আমাদের প্রিয়জন ফিরে আসুক। এই যুদ্ধে আমরা কিছুই পাচ্ছি না।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলা গাজা ও লেবাননে হামাস ও হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করতে পারে। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি শান্তি আনবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। একজন মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, “ইসরায়েলের এই কৌশল সামরিকভাবে সফল হতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এটি আরও বিচ্ছিন্নতা ডেকে আনবে।” তিনি আরও বলেন, “এই সংঘাতের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়বে।”
গাজা ও লেবাননে এই হামলা শুধু প্রাণহানির সংখ্যা নয়, এটি একটি জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার ধ্বংস। প্রতিদিন সেখানে মানুষ তাদের প্রিয়জনদের হারাচ্ছে, ঘরবাড়ি হারাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রশ্ন, কবে থামবে এই রক্তপাত? আমরা যখন এই খবর পড়ছি, তখন সেখানে কেউ হয়তো তার শেষ নিঃশ্বাস ফেলছে। এই দুঃখজনক পরিস্থিতির অবসান কবে হবে, তা এখনো অজানা। আমরা শুধু আশা করতে পারি, শান্তি ফিরে আসুক ঐ অঞ্চলগুলোতে।