শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের অভিযান নিয়ে নতুন অভিযোগ: হেফাজত নিধনে ছিল রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা
২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে পরিচালিত অভিযানে গণহত্যার অভিযোগ উঠে এসেছে নতুন করে। সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে দাবি করা হয়েছে, ওই অভিযানের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে। অভিযোগে বলা হয়, তাঁর নির্দেশেই তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ পুরো অভিযানের পরিকল্পনা করেন এবং তা বাস্তবায়নে সহায়তা করেন র্যাব গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান ও বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। এই অভিযানে আরও এক ডজনের বেশি উচ্চপদস্থ পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার কথা বলা হয়।
তথ্যমতে, অভিযানের সময় পুরো মতিঝিল এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে গভীর অন্ধকারে তিন বাহিনীর সদস্যরা একযোগে অভিযান চালান। তিন বাহিনীর এই অভিযানকে আলাদা কোডনামে ডাকা হয়—পুলিশের ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’, র্যাবের ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট শাপলা’ এবং বিজিবির ‘অপারেশন ক্যাপচার শাপলা’। অভিযানে অংশ নেয় প্রায় সাড়ে সাত হাজার সশস্ত্র সদস্য এবং ব্যবহৃত হয় দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ, যার মধ্যে ছিল টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড।
নিহতের সঠিক সংখ্যা আজও অজানা। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ তাদের অনুসন্ধানে অন্তত ৬১ জনের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করে। পুলিশের একটি গোপন প্রতিবেদনে ১৯১ জন নিহত হওয়ার তথ্য উঠে আসে। আর আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের তথ্যমতে, ওই মাসে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় ৩৬৭টি লাশ, যা স্বাভাবিকের তুলনায় চারগুণ বেশি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভিযানের পর ৬ মে ভোরে লাশ গুম করে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। র্যাব কর্মকর্তা লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান সরাসরি ঘটনাস্থলে থেকে অ্যাম্বুলেন্স ও সিটি করপোরেশনের গাড়িতে লাশ অপসারণ করেন বলে দাবি করা হয়। একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, লাশগুলো মাতুয়াইল ও পিলখানা হয়ে জুরাইন ও আজিমপুর কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে রেকর্ড রাখা হয়নি। পরে ওয়াসার গাড়িতে রক্তধোয়া হয় এবং ঘটনাস্থলের সব আলামত মুছে ফেলা হয়।
এছাড়া বলা হয়, অভিযানকে ধামাচাপা দিতে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে ঢাকায় ৫৩টি ও সারাদেশে ৮০টিরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়। বিভিন্ন মাদরাসায় হানা দিয়ে শিক্ষক-ছাত্রদের চুপ থাকতে বাধ্য করা হয়।
ঘটনার পটভূমিতে বলা হয়, ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য গঠিত হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালে ১৩ দফা দাবি জানিয়ে সরকারকে আল্টিমেটাম দেয়। এরপর ৫ মে ঢাকায় অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়, যা বিশাল সমাবেশে রূপ নেয়। সরকার একে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে এবং সমাবেশ বন্ধ করতে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। অভিযানে সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ক্যাডারদেরও অংশগ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, অভিযানে ব্যবহৃত গোলাবারুদের মধ্যে ছিল ৮০ হাজার টিয়ারশেল, ৬০ হাজার রাবার বুলেট, ৫ হাজার শটগানের গুলি, ১২ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড এবং ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি। অংশগ্রহণকারী বাহিনীর মধ্যে ছিল পুলিশের ৫,৭১২ জন, র্যাবের ১,৩০০ জন এবং বিজিবির ৫৭৬ জন সদস্য, সঙ্গে আরও কয়েকটি বাহিনীর সদস্যও উপস্থিত ছিল।
অভিযানের পেছনে নেতৃত্বে ছিলেন উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তা। যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন বেনজীর আহমেদ, জিয়াউল আহসান, আজিজ আহমেদ, পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার, অতিরিক্ত আইজিপি শহীদুল ইসলাম এবং র্যাব ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের পরিচালকরা।
এই ঘটনাকে অনেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অভিযানের সঙ্গে তুলনা করছেন। অভিযোগ অনুযায়ী, এটি ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিকল্পিত ও বাস্তবায়িত এক বর্বরতম অভিযান।