ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে তৈরি পোশাক রফতানিতে নতুন সংকট
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৫ মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত থেকে ভারতের সড়কপথ ব্যবহার করে ৩৬টি দেশে প্রায় ৫ হাজার ৬৪০ কোটি টাকার পণ্য রফতানি করা হয়েছে। ডলারে যার পরিমাণ প্রায় ৪৬২ মিলিয়ন। তবে হঠাৎ করেই ভারত এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় অনিশ্চয়তায় পড়েছে এই রফতানি কার্যক্রম।
এই পণ্য পরিবহন ট্রাকযোগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে কলকাতার বিমানবন্দর বা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে যেত। উদ্যোক্তাদের মতে, কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহারে প্রতি কেজিতে ৫০ সেন্ট থেকে ১ ডলার পর্যন্ত খরচ কম হতো এবং শাহজালাল বিমানবন্দরের বুকিং জটও এড়ানো যেত। কিন্তু এখন এই সুবিধা বন্ধ হওয়ায় নতুন করে চাপ তৈরি হয়েছে।
২০২০ সালের ২৯ জুন ভারত ‘ব্যবসা সহজীকরণ’ নীতির আওতায় ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা চালু করেছিল, যা ২০২৪ সালের ৯ এপ্রিল আকস্মিকভাবে বাতিল করে দেশটির সিবিআইসি। ওই দিনই বেনাপোলে আটকে যায় তিনটি পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের চারটি ট্রাক, যেগুলোর গন্তব্য ছিল স্পেন। কাস্টমস থেকে অনুমতি না পাওয়ায় ট্রাকগুলোকে ফিরে আসতে হয়।
বিজিএমইএর তথ্য বলছে, ১৫ মাসে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধায় ৩৪ হাজার ৯০৯ মেট্রিক টন পোশাক রফতানি হয়েছে, যার বাজারমূল্য ছিল ৫ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ২০১৮ সাল থেকে শুরু হওয়া এই সুবিধা ব্যবহার করে এ পর্যন্ত ৬২৪টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৯৮ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে, যার মধ্যে ৬০৬টি প্রতিষ্ঠান ছিল পোশাক খাতের।
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ হওয়ায় বিকল্প রফতানি রুট নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। গত বছর কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে ৪৪ হাজার টন পণ্য রফতানি হয়েছিল, যার পুরো চাপ এখন ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের ওপর পড়বে। এতে প্রায় ৭৩০টি অতিরিক্ত ফ্লাইটের প্রয়োজন পড়বে, এবং ইউরোপ-আমেরিকার রুটে খরচ ও জট দুই-ই বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
ভারতের হঠাৎ সিদ্ধান্তের কারণে বুধবার থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে ঢাকা বিমানবন্দরকে আরও দক্ষ করতে হবে এবং বিকল্প আন্তর্জাতিক রুট খুঁজতে হবে।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এই সুবিধা পুনর্বহালের ওপর গুরুত্ব দেন। বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল একে হতাশাজনক বলেও অভিহিত করেছেন। সাবেক সভাপতি রুবানা হক জানিয়েছেন, বিকল্প হিসেবে মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের সংযোগ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, এ ধরনের হঠাৎ সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক বাণিজ্যিক আস্থার জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশের উচিত বিকল্প রুট ও কাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়ানো।
এদিকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, বড় কোনো সমস্যা হবে না এবং বাংলাদেশ নিজস্ব সক্ষমতা দিয়েই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে। তিনি জানান, প্রতিবছর প্রায় ৪০-৫০ হাজার টন পণ্য এই পথে রফতানি হতো।
রফতানি হওয়া পণ্যের মধ্যে ছিল নারীদের ব্লাউজ, ব্রিফস, স্কার্ট, প্যান্ট, কোট, জামাকাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক। এসব পণ্য প্রধানত স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপানসহ ৩৬টি দেশে পাঠানো হতো।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ট্রান্সশিপমেন্ট পদ্ধতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে একটি কার্যকর ও সাশ্রয়ী সমাধান হয়ে উঠেছিল। ভারতের হঠাৎ সিদ্ধান্তে সেই পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, যা মোকাবেলায় এখন জরুরি কূটনৈতিক উদ্যোগ ও বিকল্প ব্যবস্থার দ্রুত বাস্তবায়ন।