লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় মৃত ৭, গাজায় প্রাণ গেল আরও ৩৪ ফিলিস্তিনির
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা যেন থামার নামই নিচ্ছে না। ইসরায়েলি বাহিনীর সাম্প্রতিক হামলায় লেবাননে ৭ জন এবং গাজা উপত্যকায় ৩৪ জন ফিলিস্তিনির প্রাণহানির ঘটনা বিশ্ববাসীকে আরও একবার স্তব্ধ করে দিয়েছে। এই হামলার ঘটনা শুধু মানবিক বিপর্যয়েরই সাক্ষী নয়, বরং এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের সংঘাতময় পরিস্থিতির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনাও করেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে শুরু করে স্থানীয় সূত্র, সবাই এই ঘটনাকে ঘিরে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে।
লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৭ জন নিহত হয়েছেন বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। এই হামলার লক্ষ্য ছিল হিজবুল্লাহর ঘাঁটি, যারা ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত। শনিবার (২২শে মার্চ) রাতে এই হামলা চালানো হয়, যখন ইসরায়েলি ড্রোন এবং যুদ্ধবিমান দক্ষিণ লেবাননের বিভিন্ন এলাকায় বোমাবর্ষণ করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা গেছে, হামলার সময় আকাশে তীব্র শব্দ আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গিয়েছিল।
স্থানীয় সূত্রের মতে, নিহতদের মধ্যে হিজবুল্লাহর কয়েকজন সদস্যও রয়েছেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, এই হামলা ছিল “সন্ত্রাসী ঘাঁটি” ধ্বংস করার জন্য, যেখান থেকে তাদের বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই হামলায় বেসামরিক মানুষও প্রাণ হারিয়েছেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “আমরা শুধু ঘুমিয়ে ছিলাম, হঠাৎ বোমার শব্দে ঘর কেঁপে উঠল। আমার প্রতিবেশীর বাড়িটাই আর নেই।”
লেবানন সরকার এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। হিজবুল্লাহর একজন মুখপাত্র বলেছেন, “ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের জবাব আমরা দেবো। আমাদের যোদ্ধারা প্রস্তুত।” এই ঘটনার পর লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে উত্তেজনা আরও বেড়েছে, এবং সেখানে নতুন করে সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলায় ৩৪ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় গাজার বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েলি বিমান হামলা ও স্থল অভিযানে এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই হামলায় আহত হয়েছেন আরও শতাধিক মানুষ। গাজার হাসপাতালগুলোতে আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য স্থান ও ওষুধের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
গাজার উত্তরাঞ্চলে একটি আবাসিক ভবনে ইসরায়েলি বোমা হামলায় একটি পরিবারের ১২ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, হামলার পর ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও অনেকে আটকে আছেন। একজন উদ্ধারকারী বলেন, “আমরা হাত দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরাচ্ছি, কিন্তু জীবিত কাউকে উদ্ধার করার আশা কম।” এই হামলার পর গাজার রাস্তায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা হামাসের সামরিক ঘাঁটি ও অস্ত্র ভাণ্ডার লক্ষ্য করে এই হামলা চালিয়েছে। তাদের দাবি, গাজা থেকে ইসরায়েলের দিকে রকেট হামলা চালানো হচ্ছিল, যার জবাবে তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে ফিলিস্তিনি নেতারা বলছেন, এই হামলা শুধুই বেসামরিক মানুষের ওপর আগ্রাসন। হামাসের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “ইসরায়েল শুধু ধ্বংস করতে চায়। আমাদের প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে।”
এই হামলার ঘটনায় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত আরও বাড়লে তা বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সব পক্ষকে সংযমী হতে হবে।” এছাড়া, মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইসরায়েলের এই হামলাকে “যুদ্ধাপরাধ” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনায় সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। ইসরায়েলের নিরাপত্তার পাশাপাশি বেসামরিক মানুষের জীবন রক্ষার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।” তবে, মার্কিন সমর্থনের কারণে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে, আরব বিশ্বে এই হামলার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। মিসর, জর্ডান ও সৌদি আরব এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। কায়রোতে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বিক্ষোভ হয়েছে, যেখানে হাজার হাজার মানুষ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে।
লেবানন ও গাজার সাধারণ মানুষ এখন জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। লেবাননে হামলার পর অনেকে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালিয়েছেন। গাজায় বিদ্যুৎ, পানি ও খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, “আমাদের আর কিছু বাকি নেই। শুধু বোমার শব্দ আর মৃত্যুর অপেক্ষা।”
এই হামলার পর গাজার শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানবিক সংকট আরও তীব্র হয়েছে। শিশু ও বৃদ্ধরা এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় শিকার। একজন মা বলেন, “আমার ছেলে ক্ষুধায় কাঁদছে, কিন্তু আমার কাছে তাকে দেওয়ার কিছুই নেই।”
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ও লেবাননের এই সংঘাত কবে থামবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলা শুধু প্রতিশোধের চক্রকে আরও জটিল করে তুলবে। লেবাননে হিজবুল্লাহ ও গাজায় হামাসের প্রতিরোধ যতদিন চলবে, ততদিন ইসরায়েলও তাদের সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখবে।
এই পরিস্থিতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। তবে, রাজনৈতিক ইচ্ছা ও পারস্পরিক আস্থার অভাবে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফিলিস্তিনি ও লেবানিজ জনগণের জন্য এখন প্রতিটি দিনই একটি নতুন দুঃস্বপ্ন।
লেবাননে ৭ ও গাজায় ৩৪ জনের প্রাণহানির এই ঘটনা শুধু সংখ্যা নয়, এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য পরিবারের কান্না, ধ্বংসের চিহ্ন আর একটি অঞ্চলের অস্থির ভবিষ্যৎ। বিশ্ব যখন এই ঘটনার দিকে তাকিয়ে আছে, তখন প্রশ্ন উঠছে—এই রক্তপাতের শেষ কোথায়? শান্তির পথ কি কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে, নাকি মধ্যপ্রাচ্য আরও গভীর সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাবে? উত্তরটা এখনও অধরা।