গাজাবাসীকে পূর্ব আফ্রিকায় পাঠানোর গোপন চুক্তি! যুদ্ধবিরতির মধ্যেও হামলা অব্যাহত ইসরায়েলের
ফিলিস্তিনের গাজাবাসীদের বাস্তুচ্যুত করে পূর্ব আফ্রিকার কয়েকটি দেশে পাঠানোর গোপন পরিকল্পনায় লিপ্ত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, যুদ্ধ-পরবর্তী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সুদান, সোমালিয়া ও সোমালিল্যান্ডের সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছে এই দুই দেশ। যদিও সুদান এরই মধ্যে এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে, অন্যদিকে সোমালিয়া ও সোমালিল্যান্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা এ বিষয়ে অবগত নন।
এর আগে, ওয়াশিংটনে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার নিয়ন্ত্রণ নেবে যুক্তরাষ্ট্র এবং সেখানকার ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজাবাসীদের জর্ডান ও মিশরে স্থানান্তরের প্রস্তাব দেওয়া হয়, যা নিয়ে তীব্র সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরপর আরব নেতারা গাজার জনগণকে না সরিয়ে বিকল্প পরিকল্পনার ওপর জোর দেন।
তবে সম্প্রতি হোয়াইট হাউসে আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাইকেল মার্টিনের সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্প সুর নরম করে বলেছেন, গাজা থেকে কাউকে বহিষ্কার করা হবে না। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ, গাজার জনগণকে সরানোর পরিকল্পনা নিয়ে মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এখন পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে, গাজার পুনর্গঠনের বিষয়ে কাতারের দোহায় হামাসের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ আরব নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যেখানে পাঁচটি আরব দেশ মিশরের দেওয়া পুনর্গঠন পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে।
এরই মধ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। চলমান যুদ্ধবিরতির মধ্যেও গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গত দুই দিনে ইসরায়েলি ড্রোন ও গোলাবর্ষণে গাজায় অন্তত ৮ জন নিহত হয়েছেন। আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শনিবার সকালে গাজার কেন্দ্রীয় শহর গাজা সিটিতে ড্রোন হামলায় ৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। একই সময়ে উপকূলীয় এলাকায় ইসরায়েলের নৌবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান এক ফিলিস্তিনি মৎস্যজীবী।
এর আগের দিন, গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফার আবাসিক এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর গোলাবর্ষণে এক নারীসহ আরও তিনজন নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গত কয়েক দিন ধরেই রাফা, গাজা সিটিসহ বিভিন্ন এলাকায় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি সেনারা।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে ১,২০০ জনকে হত্যা করে এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়। এরপর থেকেই ইসরায়েল গাজায় লাগাতার সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ভয়াবহ এই হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৮,৫০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাঁদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। পুরো উপত্যকা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ইসরায়েল প্রতিনিয়ত এর শর্ত লঙ্ঘন করে চলেছে বলে অভিযোগ করেছেন গাজার স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর থেকে গত দুই মাসে অন্তত ১৪০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন ইসরায়েলের হামলায়।
এদিকে, গাজার ওপর কঠোর অবরোধ জারি রেখেছে ইসরায়েল। খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে গাজাবাসীদের মানবিক সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ফ্রান্সেসকা আলবানিজ এই পদক্ষেপকে “গণহত্যার সতর্কবার্তা” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং বলেছেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় গাজায় বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
অন্যদিকে, হামাস জানিয়েছে, ইসরায়েল যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে খাদ্য ও পানিকে ব্যবহার করছে এবং এটি গাজাবাসীদের ওপর “সমন্বিত শাস্তি” দেওয়ার একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা। সংগঠনটি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এই অবরোধ তুলে নিতে ও ইসরায়েলি নেতাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
তবে বরাবরের মতোই আন্তর্জাতিক আহ্বান উপেক্ষা করে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তাঁর আগ্রাসী নীতিতে অটল রয়েছেন। ফলে চরম মানবিক সংকটের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছে ফিলিস্তিনের নিরীহ জনগণ।