সাগরতলে হারিয়ে যাওয়া শহর: মহেঞ্জোদারোর অমর রহস্য
মহেঞ্জোদারো, সিন্ধু সভ্যতার এক বিস্ময়কর নিদর্শন, যা একসময় ছিল প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ও উন্নত নগর। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে অবস্থিত এই নগরীর ধ্বংসাবশেষ আজও ইতিহাসবিদদের অবাক করে দেয়। প্রায় ৪,৫০০ বছর আগে গড়ে ওঠা এই শহরটি আধুনিক নগর পরিকল্পনার এক অনন্য উদাহরণ। কিন্তু হঠাৎ করেই এই শহর একদিন বিলীন হয়ে যায়, রেখে যায় অসংখ্য প্রশ্ন আর রহস্য।
মহেঞ্জোদারোর খননকাজ শুরু হয় ১৯২০-এর দশকে। তখন প্রত্নতাত্ত্বিকরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, এই প্রাচীন শহরের গঠন ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত। শহরের প্রতিটি ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট ছিল নিয়ম মেনে নির্মিত। রাস্তা ছিল সোজা ও গ্রিড প্যাটার্নে সাজানো, আর প্রতিটি ঘরে ছিল পাকা ইটের তৈরি মেঝে। আধুনিক ড্রেনেজ সিস্টেমের মতো একটি উন্নত নিকাশী ব্যবস্থা তখনই মহেঞ্জোদারোতে ছিল, যা প্রমাণ করে এখানকার মানুষের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ।
তবে মহেঞ্জোদারোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হল গ্রেট বাথ। এটি একটি বৃহৎ স্নানাগার, যা সম্ভবত ধর্মীয় বা সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহৃত হতো। গ্রেট বাথের পাশেই রয়েছে বিশাল ধানের গোলা, যা ইঙ্গিত দেয় যে এই শহরের বাসিন্দারা কৃষি এবং খাদ্য সংরক্ষণে কতটা দক্ষ ছিল।
মহেঞ্জোদারোর আরেকটি বিস্ময় হলো এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এখান থেকে বিভিন্ন পোড়ামাটির পুতুল, পাথরের মুদ্রা, অলঙ্কার, এবং অন্যান্য দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র উদ্ধার করেছেন। এসব নিদর্শন থেকে ধারণা করা হয়, মহেঞ্জোদারোর মানুষেরা শিল্প ও বাণিজ্যে দক্ষ ছিল। তাদের ব্যবসার পরিধি শুধু স্থানীয় নয়, বরং দূরবর্তী অঞ্চলেও বিস্তৃত ছিল।
কিন্তু এই উন্নত শহরটি কীভাবে ধ্বংস হলো, তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে আজও নানা মত রয়েছে। কেউ মনে করেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়—বন্যা বা ভূমিকম্পের কারণে শহরটি ধ্বংস হয়ে গেছে। আবার কেউ বলেন, বাইরের শত্রুরা হামলা চালিয়ে এই শহর ধ্বংস করে। তবে এখনো কোনো তত্ত্বই নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি।
আজকের দিনে মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষ কেবল এক নিদর্শন নয়; এটি একটি ইতিহাসের দিগন্ত উন্মোচন করে। এই শহর প্রাচীন মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি এবং তাদের জীবনযাত্রার উন্নতিকে চিত্রিত করে। মহেঞ্জোদারো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সভ্যতা যতই উন্নত হোক না কেন, প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের কাছে তা কতটা ক্ষণস্থায়ী হতে পারে। তাই এই শহরের ধ্বংসস্তূপে লুকিয়ে থাকা রহস্য শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতের জন্যও এক শিক্ষার বার্তা।