এনবিআর বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত: কাঠামোগত সংস্কার না কি প্রশাসনিক সংকটের সূচনা
বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণ এবং আইএমএফ থেকে ঋণের কিস্তি ছাড় নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে—জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ নামে দুটি নতুন সংস্থা গঠন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত এই দুই বিভাগের মাধ্যমে কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারের ভাষায় এটি একটি “টেকসই রাজস্ব সংস্কার”।
তবে বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরছে। এই সংস্কারের ঘোষণার পর থেকেই এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। তারা গত কয়েক দিন ধরে ‘কলম বিরতি’ কর্মসূচি পালন করছেন, যার ফলে দেশের প্রধান বন্দর, কাস্টম হাউস, কর ও ভ্যাট কার্যালয়গুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। পণ্য খালাসে বিলম্ব, কর যাচাই ও ভ্যাট প্রসেসিং থেমে যাওয়ার কারণে রাজস্ব আদায়ে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এতে একদিকে যেমন বাজেট সহায়তার অর্থ পাওয়ার পথ সুগম হয়েছে, অন্যদিকে মাঠপর্যায়ের অচলাবস্থা রাজস্ব ব্যবস্থাকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কাজ আলাদা হলে স্বার্থের সংঘাত কমে এবং দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এই মডেল বহু আগে থেকেই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সুপারিশের অংশ। ১৯৯৩ সালে আইএমএফ এবং ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও একই প্রস্তাব এসেছিল। এমনকি ২০২২ সালের আইএমএফ ঋণচুক্তিরও এটি একটি পূর্বশর্ত ছিল। বর্তমানে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭.৪ শতাংশ—দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। এই প্রেক্ষাপটেই সংস্কারের এই পদক্ষেপ।
অবশ্য কর প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা মনে করছেন, এত বড় একটি কাঠামো ভাঙার আগে পর্যাপ্ত আলোচনার প্রয়োজন ছিল। তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক ও বাস্তবতা বিবর্জিত, যা রাজস্ব ব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এরইমধ্যে বিসিএস (কর) ক্যাডারের সদস্যদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে এবং সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছে।
বাজেট ঘোষণার ঠিক আগ মুহূর্তে এমন সিদ্ধান্ত ও সংশ্লিষ্ট প্রতিক্রিয়া ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুতি ও বাস্তবায়নকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। মাঠপর্যায়ে রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আমদানি কার্যক্রমে বিলম্ব ঘটছে, যার প্রভাব বাজার ও পণ্য সরবরাহে পড়ছে। এতে মূল্যস্ফীতি ও সরবরাহ সংকট বাড়তে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, এনবিআর ভেঙে দুটি বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত যদিও কাঠামোগত সংস্কারের দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য, তবে এর বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত সময় ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার অভাব দেখা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের অসন্তোষ নিরসন করতে হবে, নইলে এই প্রশাসনিক সংকট রাজস্ব আদায় এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক শাসনে বড় ধরনের ধাক্কা আনতে পারে।
সার্বিকভাবে, এনবিআর বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত এখন কেবল একটি আর্থিক সংস্কার নয়, বরং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতার বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। যথাযথ সমাধান ছাড়া এই সংকট দীর্ঘ হলে তা দেশের অর্থনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।