বুধবার, ২১শে মে, ২০২৫| রাত ১২:২৬

ফারাক্কা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিতর্ক ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা

প্রতিবেদক
staffreporter
মে ৪, ২০২৫ ৮:২৬ অপরাহ্ণ
ফারাক্কা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিতর্ক ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা

ফারাক্কা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিতর্ক ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা

ভারতের গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের শুরু থেকেই প্রকল্পটি নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ভাটির দেশ বাংলাদেশ তো বটেই, ভারতের মধ্যেই অনেক বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ মানুষ এর বিরূপ প্রভাব নিয়ে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যদিও কলকাতা বন্দরের স্বার্থ রক্ষার যুক্তিতে বাঁধটি নির্মিত হয়েছিল, অনেকেই মনে করেন, এর বিপরীতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা উপেক্ষা করার মতো নয়।

এই বাঁধের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সেচ বিভাগের শীর্ষ প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্য। তিনি সরকারি চাকরি ছাড়ার পাশাপাশি ফারাক্কার বিরোধিতায় লেখালেখি করে পরিচিতি পান এবং পরবর্তীতে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পর, ২০১৬ সালে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ফারাক্কা বাঁধ পুরোপুরি তুলে দেওয়ার জন্য কেন্দ্র সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি জানান। তাঁর যুক্তি ছিল, বাঁধের কারণে প্রতিবছর বিহারে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। তিনি বলেছিলেন, বাঁধের কারণে গঙ্গায় পলি জমে গিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা একসময় সমুদ্রে চলে যেত।

এখন যদিও নীতিশ কুমার বিজেপির রাজনৈতিক মিত্র এবং আগের মতো সরব নন, ফারাক্কার উজানে বিহার-ঝাড়খণ্ড সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষ এখনো এই বাঁধ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আহমদাবাদ গ্রামের ওয়াহিদ শেখ মনে করেন, বর্ষায় আগেভাগেই গেট খুলে দিলে বিহারবাসীর দুর্দশা অনেক কমত। ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জের বাসিন্দা মিশির শেখ বলেন, শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার চেহারা এমন হয় যেন এটি একটি ছোট নালা, যা কৃষিকাজকে ভয়াবহভাবে প্রভাবিত করে।

ফারাক্কার বাস্তবতা নিয়ে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি নদীর বুকে চর পড়া, মাঝনদীতে বক দাঁড়িয়ে থাকা এবং গঙ্গার তীব্র ভাঙন—সবটাই নিজের চোখে দেখেছেন। স্থানীয়রা ফারাক্কা বাঁধকে একটি সাপের মাথা চেপে ধরার সঙ্গে তুলনা করেছেন—যেখানে মুখটা চেপে ধরলে সাপ ছটফট করে ওঠে, ঠিক তেমনভাবেই নদীর আচরণও হয়ে দাঁড়ায় অপ্রকৃতিযুক্ত ও ধ্বংসাত্মক।

ফারাক্কা আসনের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম বলেন, বাঁধের ফলে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের সংযোগ সহজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নদীর ড্রেজিং না করা হলে অদূর ভবিষ্যতে ভাঙনের কারণে ফারাক্কা অঞ্চলের মানুষ নদীতে তলিয়ে যেতে পারে। তাই তাঁর মতে, এই ব্যারাজ একদিকে যেমন অবকাঠামোগত সুবিধা দিয়েছে, তেমনি এলাকাবাসীর জন্য এক ধরনের অভিশাপও হয়ে উঠেছে।

নীতিশ কুমারের প্রস্তাবের পর কেন্দ্রীয় সরকার একটি দশ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছিল, যেটিতে বিহার ও কেন্দ্র থেকে পাঁচজন করে সদস্য ছিলেন। কিন্তু কমিটির অন্যতম সদস্য, নদী গবেষক হিমাংশু ঠক্কর জানান, ফারাক্কার আগ-পরে নদীর পানি ধারণক্ষমতা, বন্যার তীব্রতা বা ড্রেনেজ ব্যবস্থার তথ্য না পাওয়ায় তারা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। তবুও তিনি মনে করেন, ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব বাস্তব এবং নীতিশ কুমারের প্রস্তাব যথেষ্ট যুক্তিসম্মত।

১৯৯৬ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত গঙ্গাচুক্তির আওতায় জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা ও ফিডার ক্যানেলে পানি বণ্টনের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। দুই দেশই আলাদা জায়গায় মনিটরিং স্টেশন বসিয়ে এই প্রবাহ নিশ্চিত করে থাকে। তবে ২০২৬ সালে এই চুক্তির নবায়ন কীভাবে হবে, সেটাই নির্ধারণ করে দেবে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ।

হিমাংশু ঠক্কর বলেন, সারা বিশ্বে এখন বহু বাঁধ ডিকমিশন (অচল বা বন্ধ) করা হচ্ছে। শুধুমাত্র আমেরিকাতেই গত ৩০ বছরে ২০০০-এর বেশি বাঁধ ডিকমিশন হয়েছে। তাঁর মতে, ফারাক্কার ক্ষেত্রে ‘অপারেশনাল ডিকমিশনিং’ করা সম্ভব—মানে, বাঁধের ট্রান্সপোর্ট সংযোগ রেখে গেটগুলো খুলে দেওয়া বা তুলে নেওয়া, যাতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরে আসে। একই সঙ্গে ক্যানেলটির সুবিধা বজায় রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।

ফারাক্কা প্রকল্পের মহাপরিচালক আর ডি দেশপাণ্ডে অবশ্য বলেন, এটি কোনো জলাধার প্রকল্প নয়, বরং পানি সরানোর একটি ডাইভারশন স্কিম। ফলে পলি জমার কারণে আয়ু কমার আশঙ্কা নেই, বরং এটি শত বছরের বেশি টিকে থাকতে পারে। তবে তিনি স্বীকার করেন, ক্যানেলের পাড়ের ভাঙন ও খাতের ক্ষয় সমস্যার সমাধানে শিগগিরই ‘ক্রস রেগুলেটর’-এর মতো প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপ দরকার।

সব মিলিয়ে বলা যায়, ফারাক্কা বাঁধ আজও ভারতের জন্য এক বিতর্কিত প্রকল্প, যার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রযুক্তিগত সমাধান এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির জটিল সমীকরণের ওপর।

মন্তব্য করুন
Spread the love

সর্বশেষ - সর্বশেষ

আপনার জন্য নির্বাচিত
শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের অভিযান নিয়ে নতুন অভিযোগ: হেফাজত নিধনে ছিল রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা

শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের অভিযান নিয়ে নতুন অভিযোগ: হেফাজত নিধনে ছিল রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা

ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনা

ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনা

বাংলাদেশে চিকিৎসকদের পদোন্নতির জন্য সাত হাজার সুপারনিউমেরারি পদ সৃষ্টি প্রক্রিয়াধীন

বাংলাদেশে চিকিৎসকদের পদোন্নতির জন্য সাত হাজার সুপারনিউমেরারি পদ সৃষ্টি প্রক্রিয়াধীন

সচিবালয়ের নিরাপত্তায় বড় বিপর্যয়, সিসি ক্যামেরার ৭৯% অচল!

সচিবালয়ের নিরাপত্তায় বড় বিপর্যয়, সিসি ক্যামেরার ৭৯% অচল!

পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন হৃতিক রোশন, ‘কৃষ ফোর’-এ নতুন চমক

পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন হৃতিক রোশন, ‘কৃষ ফোর’-এ নতুন চমক

আজকের আবহাওয়া (২০ মে, ২০২৫)

আজকের আবহাওয়া (৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫)

আজকের নামাজের সময়সূচি (২০ মে, ২০২৫)

আজকের নামাজের সময়সূচি (১৩ জানুয়ারি, ২০২৫)

প্রকৃত সাংবাদিকদের স্বচ্ছ যাচাইয়ের মাধ্যমে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড দেওয়ার আশ্বাস

প্রকৃত সাংবাদিকদের স্বচ্ছ যাচাইয়ের মাধ্যমে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড দেওয়ার আশ্বাস

সচিবালয়ে গভীর রাতে অগ্নিকাণ্ড, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের আশংকা

সচিবালয়ে গভীর রাতে অগ্নিকাণ্ড, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের আশংকা

স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের জন্য সতর্কবার্তা: ক্ষতিকর অ্যাপ চিহ্নিত করে সরালো গুগল

স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের জন্য সতর্কবার্তা: ক্ষতিকর অ্যাপ চিহ্নিত করে সরালো গুগল