কাশ্মিরে পর্যটকদের ওপর হামলা- ২৬ নিহত, সৌদি থেকে তড়িঘড়ি ফিরলেন মোদি
ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মিরের পাহালগামে মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল ২০২৫) পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় কমপক্ষে ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও অনেকে। এই ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে কাশ্মিরে বেসামরিকদের ওপর সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর জেরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সৌদি আরব সফর সংক্ষিপ্ত করে বুধবার (২৩ এপ্রিল) দিল্লি ফিরেছেন এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেছেন। এই হামলা কাশ্মিরের পর্যটন শিল্প এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
হামলাটি ঘটেছে অনন্তনাগ বিভাগের পাহালগামের বৈসারান তৃণভূমিতে, যা একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্পট। এনডিটিভি এবং পিটিআই-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সন্ত্রাসীরা পাহাড়ের গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ৪০ জনের একটি পর্যটক দলকে ঘিরে ফেলে। এরপর তারা এলোপাতাড়ি গুলি চালায়, যাতে ২৬ জন নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গুলি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বিক্রেতারা নিরাপদ স্থানে সরে গেলেও পর্যটকরা গোলাগুলির মাঝে আটকা পড়েন। এক নারী প্রত্যক্ষদর্শী পিটিআইকে বলেন, “আমার স্বামীর মাথায় গুলি লেগেছে। আরও সাতজন আহত হয়েছেন। দয়া করে আমার স্বামীকে বাঁচান।” নিহতদের মধ্যে কর্ণাটকের শিভমগ্গার ব্যবসায়ী মুঞ্জুনাথ রাও (৪৭) ছিলেন, যিনি স্ত্রী পল্লবী এবং ছেলে অভিজয়ের সঙ্গে কাশ্মিরে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। পল্লবী বলেন, “আমার চোখের সামনে সন্ত্রাসীরা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। তারা বলেছে, মোদির কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে।”
জম্মু-কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ এই হামলাকে “অত্যন্ত ভয়াবহ” আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “বেসামরিকদের ওপর এত বড় হামলা আমরা আগে দেখিনি।” তিনি জানান, নিহতের সংখ্যা এখনও নিশ্চিত করা হচ্ছে। হামলার পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। মোদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাকে শ্রীনগরে গিয়ে জরুরি বৈঠকের নির্দেশ দেন। শাহ ইতিমধ্যে শ্রীনগরে পৌঁছে নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছেন। এদিকে, পাহালগামের দুর্গম এলাকায় হেলিকপ্টার পাঠিয়ে আহতদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে, কারণ এই স্থানে শুধু পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় যাওয়া সম্ভব।
হামলার খবর পাওয়ার পর মোদি সৌদি আরব সফর বাতিল করে দিল্লি ফিরে আসেন। এনডিটিভি জানায়, তার সফর বুধবার রাতে শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তিনি তড়িঘড়ি দেশে ফিরে ‘ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি’র জরুরি বৈঠকে বসেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল সৌদি নেতৃত্বকে মোদির সফর সংক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ জানান। সৌদি আরবে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সুহেল আজাজ খান বলেন, “সৌদি যুবরাজ এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন, এবং ভারত ও সৌদি আরব সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতায় একসঙ্গে কাজ করছে।”
আন্তর্জাতিক মহলেও এই হামলার তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, “কাশ্মিরের খবরে আমরা শোকাহত। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পাশে আছে।” হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, ট্রাম্প মোদির সঙ্গে ফোনে কথা বলবেন। এছাড়া, ভারতের বিরোধী দলের নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন, “নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা মানবতার বিরুদ্ধে আঘাত। এই দুঃখের মুহূর্তে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ।”
পাহালগাম, যাকে ‘ভারতের সুইজারল্যান্ড’ বলা হয়, এমন একটি মনোরম স্থান যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ভিড় করেন। এই হামলা শুধু পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগই তুলছে না, বরং কাশ্মিরের পর্যটন শিল্পের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। স্থানীয় বাসিন্দারা এই ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং দ্রুত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের দাবি জানিয়েছেন।
এই হামলার পেছনে কারা রয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছে। কাশ্মিরে দীর্ঘদিন ধরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চলছে, এবং এই ধরনের হামলা প্রায়ই এই অঞ্চলের অস্থিতিশীলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। মোদির নেতৃত্বে ভারত সরকার এখন কঠোর পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনের মাধ্যমে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইকে আরও জোরদার করার পরিকল্পনা করছে।
এই হামলা কাশ্মিরের শান্তিপূর্ণ ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধে ভারত সরকারের ওপর এখন ব্যাপক চাপ রয়েছে। নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। কাশ্মিরের এই সুন্দর উপত্যকা যেন আবার শান্তি ফিরে পায়, সেই প্রত্যাশা এখন সবার।