বৃহস্পতিবার, ২৪শে এপ্রিল, ২০২৫| রাত ৩:৩৫

টিউলিপ সিদ্দিক: বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ও প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ

প্রতিবেদক
staffreporter
এপ্রিল ২৩, ২০২৫ ৯:১১ অপরাহ্ণ
টিউলিপ সিদ্দিক: বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ও প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ

টিউলিপ সিদ্দিক: বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ও প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ

যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির সংসদ সদস্য (এমপি) টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, যিনি বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি, একসময় বলেছিলেন, “আমি বাংলাদেশি নই, আমি একজন ব্রিটিশ এমপি।” তবে সরকারি নথিপত্র এবং তদন্ত থেকে প্রকাশ পেয়েছে যে, তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), পাসপোর্ট এবং কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ধারণ করছেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশে ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত এবং আয়কর রিটার্নও জমা দিয়েছেন। এই তথ্যগুলো তাঁর বাংলাদেশি নাগরিকত্বের প্রমাণ বহন করে।

বর্তমানে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত চলছে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার একটি আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। এই ঘটনা তাঁকে লন্ডনের রাজনৈতিক এবং বাংলাদেশের আইনি মহলে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।

টিউলিপ সিদ্দিকের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব
সরকারি নথি অনুসারে, টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক বাংলাদেশের নাগরিক। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নম্বর ৫০৬৬…..৮, যা ২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি ইস্যু করা হয়। এনআইডিতে তাঁর নাম টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক (TULIP RIZWANA SIDDIQ) হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। তাঁর বাবার নাম শফিক আহমেদ সিদ্দিক এবং মায়ের নাম রেহানা সিদ্দিক। জন্মতারিখ হিসেবে উল্লেখ আছে ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮২। তাঁর রক্তের গ্রুপ বি (+) পজিটিভ। এনআইডিতে তাঁর ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ রয়েছে: বাসা/হোল্ডিং ৫৪, গ্রাম/রাস্তা ০৫, ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা, ডাকঘর নিউ মার্কেট-১২০৫, ঢাকা সিটি করপোরেশন, ঢাকা। এই ঠিকানা শেখ হাসিনার বাসভবন “সুধা সদন” হিসেবে পরিচিত।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে, টিউলিপ সিদ্দিক ঢাকার ভোটার তালিকায় নিবন্ধিত। ২০২৪ সালের ১৯ ডিসেম্বরের হালনাগাদ তথ্যে তাঁর ভোটার নম্বর ২৬১৩…….৯। এছাড়া তিনি আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন এবং তাঁর নামে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) রয়েছে।

টিউলিপ সিদ্দিকের বাংলাদেশি পাসপোর্টও রয়েছে। তাঁর প্রথম পাসপোর্ট নম্বর কিউ …..৯৯ (Q …..99), যা ২০০১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ইস্যু করা হয়। এই পাসপোর্টে জন্মস্থান এবং পাসপোর্ট প্রদানের স্থান হিসেবে লন্ডন, যুক্তরাজ্য উল্লেখ রয়েছে। পাসপোর্টে তাঁর উচ্চতা পাঁচ ফুট, পেশা শিক্ষার্থী, নাম রিজওয়ানা সিদ্দিক, বাবার নাম ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিক এবং মায়ের নাম রেহানা সিদ্দিক উল্লেখ করা হয়। এই পাসপোর্টের মেয়াদ ২০০৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর শেষ হয়।

পরবর্তীতে ২০১১ সালে তিনি পাসপোর্ট নবায়নের জন্য আবেদন করেন। নবায়নকৃত পাসপোর্টের নম্বর এএ ……৪ (AA ……4), যা ২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি ইস্যু করা হয় এবং ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি মেয়াদ শেষ হয়। এই পাসপোর্টটি বাংলাদেশের আগারগাঁও থেকে ইস্যু করা হয়, এবং এটি একটি সাধারণ (অর্ডিনারি) পাসপোর্ট। পাসপোর্টে ইমার্জেন্সি কন্টাক্ট পারসন হিসেবে শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকের নাম এবং ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা, টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিকসহ শেখ পরিবারের ১০ জনের জাতীয় পরিচয়পত্র “লক” করা হয়েছে। এই পদক্ষেপটি শেখ হাসিনার শাসনামলের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তের অংশ হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর তাঁর শাসনামলের বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই তদন্তের অংশ হিসেবে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। দুদকের অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে সম্প্রতি ঢাকার একটি আদালত টিউলিপ সিদ্দিক, শেখ হাসিনাসহ ৫৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

এই ঘটনার পর টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের হ্যাম্পস্টিড অ্যান্ড হাইগেট আসনের এমপি হিসেবে তাঁর পদে থাকলেও তিনি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। গত জানুয়ারিতে তিনি যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের “সিটি মিনিস্টার” পদ থেকে ইস্তফা দেন। এই ইস্তফার পেছনে বাংলাদেশে তাঁর বিরুদ্ধে চলমান তদন্ত এবং রাজনৈতিক চাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে ধারণা করা হয়।

টিউলিপ সিদ্দিকের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশে তাঁর বিরুদ্ধে জারি হওয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে লন্ডনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন টিউলিপ সিদ্দিক। তিনি বলেন, “বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তারা পুরো সময় মিডিয়া ট্রায়াল চালিয়েছে। আমার আইনজীবীরা উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছিলেন, কিন্তু তারা কখনো এর জবাব দেয়নি।”

তিনি আরও বলেন, “এই অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং আমাকে হয়রানি করার জন্য করা হয়েছে। আমি নিশ্চিত, এই অপপ্রচারের পেছনে কোনো প্রমাণ নেই। আমি কোনো ভুল করিনি।” টিউলিপ সিদ্দিক এই অভিযোগগুলোকে “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা” হিসেবে উল্লেখ করে এর গুরুত্ব কমানোর চেষ্টা করেছেন।

বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে বিতর্ক
টিউলিপ সিদ্দিক ২০১৭ সালে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, “আমি বাংলাদেশি নই, আমি একজন ব্রিটিশ এমপি।” তবে তাঁর এই বক্তব্যের পর সরকারি নথিপত্রে তাঁর বাংলাদেশি নাগরিকত্বের তথ্য প্রকাশিত হওয়ায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তাঁর এনআইডি, পাসপোর্ট, ভোটার তালিকায় নাম এবং আয়কর রিটার্ন জমার তথ্য স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক।

এই বিতর্ক তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্য হিসেবে তাঁর ভূমিকা এবং বাংলাদেশে তাঁর সম্পদ ও সম্পত্তি নিয়ে তদন্ত তাঁকে আরও বিতর্কের মুখে ফেলেছে।

তদন্ত ও আইনি পদক্ষেপ
দুদক বর্তমানে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করছে। এই তদন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলের বিস্তৃত দুর্নীতি তদন্তের অংশ। অভিযোগে বলা হয়েছে, টিউলিপ সিদ্দিক শেখ হাসিনার প্রভাব ব্যবহার করে অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকার আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

তবে টিউলিপ সিদ্দিক বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন, এবং তিনি এই অভিযোগের বিষয়ে সরাসরি কোনো আইনি পদক্ষেপের মুখোমুখি হননি। তাঁর আইনজীবীরা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোনো সাড়া পাননি বলে তিনি দাবি করেছেন।

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ এবং তাঁর বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে বিতর্ক বাংলাদেশ এবং যুক্তরাজ্যে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসনামলের পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই তদন্তকে অনেকে শেখ পরিবারের প্রভাব কমানোর প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যে তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এই অভিযোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর তিনি এটিকে “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা” হিসেবে উল্লেখ করলেও, বাংলাদেশের সরকারি নথি এবং তদন্ত তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শেখ পরিবারের প্রভাব এবং দুর্নীতির অভিযোগের একটি নতুন অধ্যায় যোগ করেছে।

আগামী দিনে এই তদন্তের ফলাফল এবং টিউলিপ সিদ্দিকের আইনি পদক্ষেপ কীভাবে এগোয়, তা বাংলাদেশ এবং যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক মহলে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে। 

মন্তব্য করুন
Spread the love

সর্বশেষ - বানিজ্য ও অর্থনীতি

আপনার জন্য নির্বাচিত
যুক্তরাষ্ট্রে রানওয়ে থেকে ছিটকে গিয়ে দুই উড়োজাহাজের সংঘর্ষ, নিহত ১

যুক্তরাষ্ট্রে রানওয়ে থেকে ছিটকে গিয়ে দুই উড়োজাহাজের সংঘর্ষ, নিহত ১

৩ দিনে গাজায় ঢুকেছে ২ হাজার ৪ শতাধিক ত্রাণবাহী ট্রাক: জাতিসংঘ

৩ দিনে গাজায় ঢুকেছে ২ হাজার ৪ শতাধিক ত্রাণবাহী ট্রাক: জাতিসংঘ

এরদোগানের প্রশংসা, ট্রাম্পের মতে সিরিয়ার চাবি তুরস্কের হাতে

‘নো ওয়ার্ক, নো স্কুল’ কর্মসূচি: গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে বাংলাদেশের সংহতি প্রকাশ

‘নো ওয়ার্ক, নো স্কুল’ কর্মসূচি: গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে বাংলাদেশের সংহতি প্রকাশ

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান শক্তির নতুন প্ল্যাটফরম আসছে, ঘোষণা জুনায়েদের

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান শক্তির নতুন প্ল্যাটফরম আসছে, ঘোষণা জুনায়েদের

আজকের মুদ্রার হার (২৩ এপ্রিল, ২০২৫)

আজকের মুদ্রার হার (২১ জানুয়ারি, ২০২৫)

এআই নিয়ে মোদি'র কল্পনাপ্রসূত উদ্ভট দাবি, বিশ্বব্যাপী ট্রোল

এআই নিয়ে মোদি’র কল্পনাপ্রসূত উদ্ভট দাবি, বিশ্বব্যাপী ট্রোল

ডিজিটাল অ্যারেস্ট ফাঁদে পড়ে যা হারালেন তরুণী

"আ.লীগ স্বাধীনতা তো দূরের কথা, স্বাধীনতা শব্দটির ধারণাই পাল্টে দিয়েছে"

“আ.লীগ স্বাধীনতা তো দূরের কথা, স্বাধীনতা শব্দটির ধারণাই পাল্টে দিয়েছে”

রমজান উপলক্ষে ১,২৯৫ বন্দিকে মুক্তি দিচ্ছে আমিরাত প্রেসিডেন্ট

রমজান উপলক্ষে ১,২৯৫ বন্দিকে মুক্তি দিচ্ছে আমিরাত প্রেসিডেন্ট