ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুদকের অর্থপাচার মামলা বাতিল: নোবেল বিজয়ীর আইনি জয়
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা অর্থপাচার মামলা বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এই রায়ের মধ্য দিয়ে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ টেলিকমের ছয়জন শীর্ষ কর্মকর্তা আইনি লড়াইয়ে জয়ী হয়েছেন। মামলাটিকে ‘হয়রানিমূলক’ উল্লেখ করে ড. ইউনূসের আইনজীবী এবং দুদকের আইনজীবী উভয়েই বলেছেন, এই মামলার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। বুধবার (২৩ এপ্রিল ২০২৫) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগ সর্বসম্মতভাবে এই রায় দেন, যা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
মামলাটি ২০২৩ সালের ৩০ মে দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার বাদী হয়ে দায়ের করেছিলেন। অভিযোগে বলা হয়েছিল, ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ টেলিকমের ছয় কর্মকর্তা—নাজমুল ইসলাম, আশরাফুল হাসান, নাজনীন সুলতানা, শাহজাহান, নূরজাহান বেগম ও এস এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী—২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করেছেন। গত বছরের ১২ জুন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক সৈয়দ আরাফাত হোসেন এই মামলায় অভিযোগ গঠন করেন। তবে ড. ইউনূস এবং তার দল এই অভিযোগকে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়ের হওয়া এই মামলাটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়। ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “এই মামলা ছিল সম্পূর্ণ হয়রানিমূলক। শ্রমিকদের টাকা তাদের অ্যাকাউন্টে বিতরণ করা হয়েছে, এটি কোম্পানির টাকা নয়। ড. ইউনূসকে অপমান ও হয়রানি করার জন্যই এই মামলা করা হয়েছিল।” তিনি আরও বলেন, গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. ইউনূস ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন। এর তিন দিন পর, ১১ আগস্ট, দুদক কোনো নোটিশ বা কারণ ছাড়াই মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করে, যা ড. ইউনূস মেনে নেননি। তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আসিফ হাসানও মামলার সিদ্ধান্তকে ভুল বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “ড. ইউনূস বিশ্বব্যাপী সম্মানিত এবং বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী। তার বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না।” তিনি মনে করেন, এই মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা হয়েছিল।
মামলার প্রক্রিয়ায় ড. ইউনূস প্রথমে হাইকোর্টে অভিযোগ গঠন ও মামলার কার্যক্রম বাতিলের আবেদন করেন। গত বছরের ২৪ জুলাই বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের বেঞ্চ এই আবেদন খারিজ করে দেন। এরপর ড. ইউনূস আপিল বিভাগে আবেদন করেন। ২০২৪ সালের ২১ অক্টোবর আপিল বিভাগ আপিলের অনুমতি দেয় এবং গত ১৯ মার্চ শুনানি শেষে ২৩ এপ্রিল রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করে।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, ড. ইউনূসের পক্ষে ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন এবং দুদকের পক্ষে অ্যাডভোকেট আসিফ হোসাইন উপস্থিত ছিলেন। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ড. ইউনূসের আপিল মঞ্জুর করে এবং মামলাটি বাতিল ঘোষণা করে।
ড. ইউনূস নিজেও এই মামলার বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের পক্ষে ছিলেন। তার আইনজীবী উদ্ধৃত করে বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পরপরই মামলা প্রত্যাহারের চেষ্টা হয়, কিন্তু আমি আইনি প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা করতে চাই। যদি দোষী প্রমাণিত হই, সাজা মেনে নেব।” এই অবস্থানের মধ্য দিয়ে তিনি তার সততা ও নীতির প্রতি অটল থাকার বার্তা দিয়েছেন।
এই রায়ের পর ড. ইউনূসের সমর্থকরা এটিকে ন্যায়বিচারের জয় হিসেবে দেখছেন। তবে এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আইনি প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে—বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে কতটা স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা থাকছে? ড. ইউনূসের এই আইনি জয় কেবল তার ব্যক্তিগত বিজয় নয়, বরং দেশের বিচার ব্যবস্থায় ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার একটি পদক্ষেপ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
এই ঘটনা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকে মনে করেন, ড. ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা দেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। আবার কেউ কেউ এটিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফল বলেও মনে করছেন। যাই হোক, আপিল বিভাগের এই রায়ের মধ্য দিয়ে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগের অধ্যায়টি শেষ হয়েছে, এবং তিনি তার কাজ ও মিশন নিয়ে আরও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাওয়ার পথ পেয়েছেন।


