বৃহস্পতিবার, ২৪শে এপ্রিল, ২০২৫| রাত ৩:৫৭

কম্বোডিয়ার সৌর প্যানেলে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫২১ শতাংশ শুল্ক আরোপ: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা

প্রতিবেদক
staffreporter
এপ্রিল ২৩, ২০২৫ ৮:৫৪ অপরাহ্ণ
কম্বোডিয়ার সৌর প্যানেলে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫২১ শতাংশ শুল্ক আরোপ: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা

কম্বোডিয়ার সৌর প্যানেলে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫২১ শতাংশ শুল্ক আরোপ: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা

যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চারটি দেশ—কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ভিয়েতনাম—থেকে আমদানি করা সৌর প্যানেলের উপর অত্যধিক শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে কম্বোডিয়ার কিছু কোম্পানির সৌর প্যানেলের উপর সর্বোচ্চ ৩,৫২১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে, যা বাণিজ্য ক্ষেত্রে একটি অভূতপূর্ব পদক্ষেপ। এই শুল্ক নীতির লক্ষ্য মার্কিন সৌর প্যানেল শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া, তবে এটি এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে, এবং আগামী জুন মাসে মার্কিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশন এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

শুল্ক আরোপের পটভূমি
২০২৪ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের কাছে মার্কিন সৌর প্যানেল উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো তাদের শিল্পকে রক্ষার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়। তারা অভিযোগ করে যে, চীনা কোম্পানিগুলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে কারখানা স্থাপন করে সেখান থেকে কম দামে সৌর প্যানেল যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করছে। এই কম দামের পণ্যের কারণে মার্কিন কোম্পানিগুলো বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তদন্ত শুরু করে এবং এই অত্যধিক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব উত্থাপন করে। এই শুল্কগুলো পাল্টাপাল্টি এবং ডাম্পিং-বিরোধী শুল্ক হিসেবে পরিচিত, যা কোম্পানি এবং দেশভেদে ভিন্ন হতে পারে।

দেশ ও কোম্পানি অনুযায়ী শুল্কের হার
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশের কোম্পানির সৌর প্যানেলের উপর নিম্নলিখিত শুল্ক আরোপ করা হবে:

– **কম্বোডিয়া**: কিছু কোম্পানির সৌর প্যানেলের উপর ৩,৫২১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এই অভাবনীয় শুল্কের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কম্বোডিয়ার এই কোম্পানিগুলো মার্কিন তদন্তে সহযোগিতা করেনি।
– **মালয়েশিয়া**: চীনা কোম্পানি জিনকো সোলারের মালয়েশিয়ায় উৎপাদিত সৌর প্যানেলের উপর ৪১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।
– **থাইল্যান্ড**: ত্রিনা সোলারের থাইল্যান্ডে উৎপাদিত পণ্যের উপর ৩৭৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে।
– **ভিয়েতনাম**: এই দেশের কোম্পানিগুলোর উপরও শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে, তবে নির্দিষ্ট হার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।

শুল্ক আরোপের কারণ
মার্কিন সৌর প্যানেল উৎপাদনকারীদের অভিযোগ, চীনা কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি এড়াতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে তাদের উৎপাদন কারখানা স্থানান্তর করেছে। এই কৌশলের মাধ্যমে তারা কম দামে সৌর প্যানেল যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে বাজার দখল করছে। ইউএস সেন্সাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র এই চারটি দেশ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সৌর প্যানেল আমদানি করেছে, যা মার্কিন বাজারে এই পণ্যের উল্লেখযোগ্য প্রভাব নির্দেশ করে।

এর আগে, ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে (২০১৭-২০২১) চীনা পণ্যের উপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছিলেন। এর ফলে চীনা কোম্পানিগুলো শুল্ক এড়াতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে তাদের কারখানা স্থানান্তর শুরু করে। বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক নীতি এই কৌশলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

শুল্কের সম্ভাব্য প্রভাব
এই অত্যধিক শুল্ক আরোপের ফলে মার্কিন সৌর প্যানেল উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো উপকৃত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তারা বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সুবিধা পাবে এবং তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারবে। এটি মার্কিন অর্থনীতিতে স্থানীয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং শিল্পের প্রসারে ভূমিকা রাখতে পারে।

তবে, এই শুল্কের নেতিবাচক দিকও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে যারা কম দামে সৌর প্যানেল ক্রয় করে সৌরশক্তি প্রকল্পে ব্যবহার করতেন, তারা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। শুল্কের কারণে সৌর প্যানেলের দাম বৃদ্ধি পেলে সৌরশক্তি প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে, যা যুক্তরাষ্ট্রের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই শুল্ক আরোপের ঘোষণা এসেছে এমন এক সময়ে, যখন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সম্প্রতি ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া এবং কম্বোডিয়া সফর করেছেন। সফরকালে তিনি এই দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের “বাণিজ্যিক গুণ্ডামি” রুখে দেওয়ার আহ্বান জানান। শি জিনপিংয়ের এই বক্তব্যের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা প্রকাশিত হওয়ায় এটি চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রে ৩,৫২১ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত বিশেষভাবে সমালোচিত হচ্ছে। এই অভূতপূর্ব শুল্ক হার দেশটির সৌর প্যানেল রপ্তানি শিল্পের উপর গভীর প্রভাব ফেলবে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই শুল্ক কম্বোডিয়ার কোম্পানিগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ প্রায় অসম্ভব করে তুলবে।

বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক নীতি বৈশ্বিক সৌর প্যানেল শিল্প এবং বাণিজ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বর্তমানে বিশ্বের সৌর প্যানেল উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এই শুল্কের ফলে এই দেশগুলোর রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হলে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন এবং সৌরশক্তি প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে।

এছাড়া, এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধকে আরও তীব্র করতে পারে। চীন ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে, যা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

উপসংহার
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সৌর প্যানেলের উপর অত্যধিক শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা মার্কিন স্থানীয় শিল্পকে রক্ষা করার একটি কৌশল হলেও, এটি বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। কম্বোডিয়ার কোম্পানিগুলোর উপর ৩,৫২১ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত এই নীতির কঠোরতা প্রকাশ করে। আগামী জুনে মার্কিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এই শুল্ক নীতির ভবিষ্যৎ এবং এর বৈশ্বিক প্রভাব নির্ধারণ করবে।

এই শুল্ক নীতি কার্যকর হলে মার্কিন ভোক্তা এবং সৌরশক্তি প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতি এবং বৈশ্বিক সৌর প্যানেল বাজারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যেতে পারে।

মন্তব্য করুন
Spread the love

সর্বশেষ - বানিজ্য ও অর্থনীতি