গাজায় হামলা জোরদারের নির্দেশ নেতানিয়াহুর, জিম্মিদের প্রাণহানির আশঙ্কা”
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্মম হামলা ক্রমশ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এই হামলায় কমপক্ষে ৫২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও শতাধিক মানুষ। এর ফলে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলমান এই সংঘাতে নিহতের সংখ্যা ৫১,১৫৭-এ পৌঁছেছে, আহত হয়েছেন ১ লাখ ১৬ হাজার ৭২৪ জন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ মার্চ থেকে নতুন করে শুরু হওয়া এই হামলায় ১,৭৮৩ জন নিহত এবং প্রায় ৪,৭০০ জন আহত হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হামলা আরও জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন, যা গাজার মানুষের জন্য নতুন করে আতঙ্ক তৈরি করেছে।
শনিবার (১৯ এপ্রিল) সারা দিন গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলা অব্যাহত ছিল। বার্তাসংস্থা আনাদোলু এবং সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই হামলায় বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। গত ৪৮ ঘণ্টায় আহত ২১৯ জনকে গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তবে ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও অনেকে আটকা পড়ে আছেন, এবং উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। এই হামলা গত জানুয়ারিতে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের কারণে গাজার ৮৫ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, এবং ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।
এদিকে, হামলার মধ্যে একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। হামাসের সামরিক শাখার মুখপাত্র আবু উবাইদা জানিয়েছেন, ইসরায়েলি-আমেরিকান জিম্মি এডেন আলেক্সান্ডারের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এডেন, যিনি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা সীমান্ত থেকে হামাসের হাতে বন্দি হয়েছিলেন। গত সপ্তাহে তার অবস্থানের কাছে ইসরায়েলি হামলার পর তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন হামাস গার্ডের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু এডেনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, তিনি ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়ে থাকতে পারেন। এটি যদি সত্য হয়, তবে এটি নেতানিয়াহুর ওপর আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপ আরও বাড়িয়ে দেবে।
হামাসের মুখপাত্র আবু উবাইদা বলেছেন, “আমরা সব জিম্মিকে রক্ষা করার চেষ্টা করছি, কিন্তু ইসরায়েলের অব্যাহত বোমা হামলা তাদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।” তিনি আরও অভিযোগ করেছেন যে ইসরায়েল জিম্মিদের সঙ্গে অমানবিক আচরণের মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে এবং হামাসের প্রতিরোধ লড়াইয়ের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে।
এডেন আলেক্সান্ডারের আমেরিকান নাগরিকত্ব থাকায় যুক্তরাষ্ট্র গত মাস থেকে তাকে মুক্ত করার জন্য হামাসের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করছিল। শোনা যাচ্ছে, এডেনসহ আরও চারজন মৃত মার্কিন জিম্মির বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হামাসের সঙ্গে কথা বলতে পারে। কিন্তু এডেনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এই প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়েছে।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাও এখন ক্ষীণ। হামাস আরেকটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বন্দিদের মুক্তির বিনিময়ে সংঘাতের পূর্ণ অবসানের দাবি জানিয়েছে। নেতানিয়াহু এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে গাজায় সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। গত ১৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু হামাসের সঙ্গে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে মতবিরোধের জেরে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আবার হামলা শুরু হয়।
গাজার মানবিক সংকট এখন চরমে। ইসরায়েলের হামলা এবং ত্রাণ সরবরাহে বাধার কারণে খাদ্য, পানি, এবং ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, গাজায় দুর্ভিক্ষ আসন্ন। এদিকে, গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত নেতানিয়াহু এবং তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলা চলছে।
এই সংঘাতের মধ্যে গাজার সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ অবর্ণনীয়। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বেঁচে থাকা, প্রিয়জন হারানো, এবং নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং মানবিক সহায়তার জন্য আকুতি জানাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু নেতানিয়াহুর কঠোর অবস্থান এবখি। এই পরিস্থিতিতে গাজার মানুষের দুর্ভোগ আর জিম্মি সংকট শান্তির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।