প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ
ঢাকা, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪:
আজকের মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভাষণে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদদের আত্মত্যাগ, দেশের বর্তমান অবস্থার উন্নয়ন এবং ভবিষ্যতে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নির্বাচন নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা তুলে ধরেন। এই ভাষণে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
স্বাধীনতার অর্জন: শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা
ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণে বলেন, ‘‘আজ বিজয় দিবস বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক বিশেষ দিন, যখন শহীদদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে সম্মুখ সমরে লড়াই করে বাঙালি জাতি নিজের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল।’’ তিনি শহীদদের স্মরণ করে বলেন, ‘‘আজকের এই দিনটি আমাদের জন্য এক অন্য রকম গৌরবময় উপলক্ষ, কারণ এই দিনেই আমরা শ্রদ্ধা জানাই অগণিত শহীদ, শিশু, যুবক, যুবতী, বৃদ্ধদের যাদের আত্মত্যাগের ফলে স্বাধীনতা সম্ভব হয়েছে।’’
স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্রজনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান
ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘‘আমরা স্বাধীনতার অর্জনকে পূর্ণতা দিতে পারিনি, এবং সর্বশেষ আঘাত হেনেছে একটি স্বৈরাচারী সরকার। তবে, গত চার মাসে দেশবাসী একত্রিত হয়ে পৃথিবীর ঘৃণ্যতম স্বৈরাচারী শাসককে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।’’ তিনি ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানকে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেন এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সরকারের ঘৃণ্য স্বৈরাচারী আচরণে দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধকে স্বীকৃতি দেন।
জাতীয় ঐকমত্য গঠন: দেশের ভবিষ্যতের পথচলা
ড. ইউনূস তাঁর ভাষণে জানান, দেশের সংস্কারের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, এবং এখন একটি নতুন ‘‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’’ প্রতিষ্ঠিত হবে। এই কমিশন রাজনৈতিক দলসহ সকল পক্ষের মধ্যে মতামত বিনিময় করবে, ঐকমত্য স্থাপন করবে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সুপারিশ করবে। ‘‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশনের’’ প্রধান হিসেবে ড. ইউনূস নিজে দায়িত্ব পালন করবেন এবং অধ্যাপক আলী রীয়াজ সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা ফিরেছে
দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘‘অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনীতি ছিল সংকটাপন্ন, কিন্তু গত চার মাসে তা দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা ফিরেছে এবং দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের মধ্যে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার হয়েছে।’’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘‘বিগত সরকারগুলির সময়ে ব্যাংক খাতে ব্যাপক অনিয়ম ছিল, কিন্তু সরকার কোন ব্যাংক বন্ধ করেনি, বরং দুর্বল ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’’
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: বাজার তদারকি ও আমদানি ব্যবস্থার পরিবর্তন
প্রধান উপদেষ্টা স্বীকার করেন যে, মূল্যস্ফীতি এখনো কাঙ্ক্ষিত স্তরে পৌঁছায়নি। তিনি বলেন, ‘‘গত কয়েক মাসে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। তবে আমরা সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছি, আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়ে এবং বাজার তদারকির মাধ্যমে দাম কমানোর চেষ্টা করছি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি, তবে এটি বন্ধ হলে বাজারে মূল্যস্ফীতি আরও নিয়ন্ত্রণে আসবে।’’
নির্বাচন: ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক সমর্থন
ড. ইউনূস বলেন, ‘‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আয়োজনের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে।’’ তিনি জানান, ‘‘কিছু দিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৯ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, যা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।’’ তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশকে সহযোগিতা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগে সহায়তা বৃদ্ধি করার আহ্বান জানান।
জাতীয় নির্বাচন: ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে
ড. ইউনূস বলেন, ‘‘২০২৫ সালের শেষে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। তবে যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কিছু সংস্কার প্রয়োগ করা হয়, তাহলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে আরও ছয় মাস সময় লাগতে পারে।’’ তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘‘ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নতুন ভোটারদের অন্তর্ভুক্তি, এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটদান নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
তরুণ ভোটারদের প্রতি আহ্বান: ১০০% ভোটদান
ভাষণের শেষের দিকে, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তরুণ ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘‘আমরা সবাই মিলে একটি ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে পারি, যেখানে প্রথমবারের ভোটাররা শতভাগ ভোটদান নিশ্চিত করবে।’’ তিনি বলেন, ‘‘এটা আমাদের জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়।’’