বুধবার, ১৪ই মে, ২০২৫| রাত ৯:৩৫

“বাংলাদেশি” তকমায় চাপে ভারতের বাংলাভাষী মুসলমানরা: রাষ্ট্রীয় অভিযানের ছায়ায় নিপীড়নের আশঙ্কা

প্রতিবেদক
staffreporter
এপ্রিল ৩০, ২০২৫ ৬:৫৮ অপরাহ্ণ
“বাংলাদেশি” তকমায় চাপে ভারতের বাংলাভাষী মুসলমানরা: রাষ্ট্রীয় অভিযানের ছায়ায় নিপীড়নের আশঙ্কা

“বাংলাদেশি” তকমায় চাপে ভারতের বাংলাভাষী মুসলমানরা: রাষ্ট্রীয় অভিযানের ছায়ায় নিপীড়নের আশঙ্কা

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী মুসলমানদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে এক নিঃশব্দ নিধনযজ্ঞের মতো অভিযান। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে যেভাবে হাজার হাজার মানুষকে ‘সন্দেহভাজন বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করে আটক ও উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে, তা এখন শুধু ভারত নয়—আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিতেও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

সম্প্রতি গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা ও মহারাষ্ট্রে যে ধরণের অভিযান চালানো হয়েছে, তা কেবল প্রশাসনিক তৎপরতা নয়—একে অনেকে দেখছেন জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্ররোচনায় চালানো নিপীড়নের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।

গুজরাট পুলিশ জানিয়েছে, শুধুমাত্র গত এক সপ্তাহেই সেখানে সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তারা ‘বাংলাদেশি’। অথচ এই বিশাল সংখ্যার মধ্যে মাত্র ৪৫০ জনের পরিচয় যাচাই করে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাহলে প্রশ্ন উঠছে—বাকি ৬ হাজার মানুষ কে? কেন তাদের গ্রেফতার করা হলো? তারা কি শুধুই সন্দেহভাজন, নাকি তাদের মুসলমান পরিচয়ই তাদের অপরাধ?

এই পরিস্থিতিতে দেশটির নানা প্রান্ত থেকে উঠে আসছে মানবিক বিপর্যয়ের করুণ চিত্র। বিবিসি বাংলার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে—এই আচমকা ধড়পাকড়ে শত শত পরিবার তাদের স্বজনদের খোঁজে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’ নামে একটি মানবাধিকার সংগঠন মাত্র দুদিনে ১০০’র বেশি নিখোঁজ সংক্রান্ত অভিযোগ পেয়েছে।

সংগঠনটির রাজ্য সম্পাদক আসিফ ফারুক জানান, “গুজরাটে বেশি ঘটনা ঘটেছে বলে সেখানকার খবর সামনে এসেছে, কিন্তু বাস্তবে একই রকম ঘটনা ঘটছে উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা এবং মহারাষ্ট্রেও। বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি’ বলে হেনস্তা করার প্রবণতা ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে।” তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে লিখিতভাবে অবহিত করা হলেও মাঠপর্যায়ে কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।

এই প্রবণতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে কিছু সাম্প্রতিক ঘটনার দিকে তাকালে।
১৮ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশে মালদা জেলার ২৩ জন ফেরিওয়ালা শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার ‘অপরাধে’ হামলার শিকার হন। তাদের পরে পুলিশ হেফাজতে নেয়। আবার ২১ এপ্রিল, মুর্শিদাবাদ জেলার ৬০ জন শ্রমিক যখন ওড়িশায় কাজের সন্ধানে যাচ্ছিলেন, ময়ূরভঞ্জে স্থানীয় লোকজন তাদের ওপর চড়াও হয়। শেষমেশ আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় তাদের ফিরে আসতে হয় নিজ জেলায়।

এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে—এই ভারতীয় সংবিধানে কি মুসলমান বা বাংলাভাষীদের অধিকার সুরক্ষিত আছে? দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার কি আজ চূড়ান্ত পরীক্ষা চলছে?

যদি একজন ভারতীয় নাগরিক তার ধর্ম বা ভাষার কারণে “বাংলাদেশি” তকমা পায়, তাহলে সে দেশ কি আর তার নিজের থাকে? আর যদি রাষ্ট্রীয় মদদে এই ধরণের বৈষম্যমূলক অভিযান চালানো হয়, তাহলে তা কি গণতন্ত্রের আত্মার পরিপন্থী নয়?

এই প্রশ্নগুলো শুধু ভারতের নয়—পুরো উপমহাদেশের কাছে এখন বড় এক ভাবনার বিষয়।

কারণ এই প্রবণতা চলতে থাকলে একদিন হয়তো বাংলা ভাষায় কথা বলাটাই হয়ে উঠবে ‘অপরাধ’। ‘বাংলাদেশি’ পরিচয় হয়ে দাঁড়াবে ভয়াবহ এক অপবাদ, যার নামেই নিপীড়িত হবে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ।

এই বাস্তবতাই আজ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে আমাদের মানবতাবোধে।

“বাংলাদেশি” তকমা কি আসলে একে একে মুছে দিতে চায় মানুষের মর্যাদা, আত্মপরিচয় আর বেঁচে থাকার অধিকার?
আপনি কি প্রস্তুত এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে?

মন্তব্য করুন
Spread the love

সর্বশেষ - সর্বশেষ