রবিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৫| বিকাল ৫:৩৬

তুর্কিদের রাজত্ব: তুরস্কের ইতিহাসে সাম্রাজ্যের উত্তরণ থেকে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের গল্প

প্রতিবেদক
staffreporter
এপ্রিল ২০, ২০২৫ ১২:০৬ অপরাহ্ণ
তুর্কিদের রাজত্ব: তুরস্কের ইতিহাসে সাম্রাজ্যের উত্তরণ থেকে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের গল্প

তুর্কিদের রাজত্ব: তুরস্কের ইতিহাসে সাম্রাজ্যের উত্তরণ থেকে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের গল্প

তুরস্কের ইতিহাস এক গভীর, বর্ণময় এবং চমকপ্রদ যাত্রাপথের দলিল। এটি শুধু একটি দেশের ইতিহাস নয়, বরং এক বিস্তৃত সাম্রাজ্যের ধ্বনি—যার শিকড় মধ্য এশিয়ায়, বিস্তার ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তৃত প্রান্তে, এবং যার প্রভাব আজও ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্ব রাজনীতিতে।

তুর্কিদের ইতিহাস শুরু হয় মধ্য এশিয়ার স্টেপ অঞ্চল থেকে। প্রাথমিকভাবে তুর্কি গোত্রগুলো ছিল যাযাবর এবং যুদ্ধে দক্ষ। ধীরে ধীরে তারা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, যার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাগ গঠন করে সেলজুক তুর্কিদের। সেলজুক সাম্রাজ্য ১১শ শতকে পারস্য ও আনাতোলিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে এবং ইসলামি সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এরপর আসে এক চিরস্মরণীয় অধ্যায়—উসমানীয় সাম্রাজ্য বা অটোমান এম্পায়ার। ১৩শ শতকের শেষভাগে উসমান গাজীর নেতৃত্বে এই সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। ধীরে ধীরে তারা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তানবুল) দখল করে নেয়। এই জয়ের মাধ্যমে অটোমানরা পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। একসময় এই সাম্রাজ্য ছিল তিনটি মহাদেশজুড়ে বিস্তৃত—ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা।

অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সংগঠিত। তারা বিচার ব্যবস্থা, স্থাপত্য, শিক্ষা এবং ধর্মীয় সহাবস্থানকে গুরুত্ব দিয়েছিল। সুলতান সুলাইমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট-এর শাসনকাল ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ। সেই সময় স্থাপত্যে উঠে আসে সিঞ্জান-মসজিদ, টপকাপি প্রাসাদ ও অন্যান্য দর্শনীয় নিদর্শন।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যে দুর্বলতা দেখা দেয়। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির উত্থান, প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতা এবং অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি এই সাম্রাজ্যকে ক্রমশ ভঙ্গুর করে তোলে। অবশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান মিত্র হিসেবে অংশ নিয়ে অটোমানরা পরাজিত হয়। এর ফলেই ১৯২৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্র।

এই নতুন রাষ্ট্রের স্থপতি ছিলেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। তিনি কট্টর আধুনিকতাবাদী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং তুরস্ককে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলেন। তিনি আরবি লিপির পরিবর্তে লাতিন হরফ চালু করেন, নারীদের শিক্ষা ও ভোটাধিকার দেন, ইসলামিক আইন বাতিল করে পাশ্চাত্য ধাঁচের আইন চালু করেন।

তুরস্কের এই রূপান্তর ছিল নাটকীয়, অনেকটা বিপ্লবের মতো। সাম্রাজ্য থেকে প্রজাতন্ত্র—এই যাত্রায় তুরস্ক ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ হয়ে ওঠে। আজকের আধুনিক তুরস্ক একদিকে ইউরোপ ও এশিয়ার সেতুবন্ধন, আবার অন্যদিকে প্রাচীন ও আধুনিকতার মেলবন্ধন।

তুরস্কের ইতিহাস শুধু বিজয়ের, সংস্কৃতির বা আধুনিকায়নের গল্প নয়, এটি একটি জাতির দৃঢ় সংকল্প, পরিবর্তনের সাহস এবং পরিচয় রক্ষার সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। আর সেই কারণেই তুর্কিদের রাজ ইতিহাস বিশ্ব ইতিহাসে আজও এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়।

মন্তব্য করুন
Spread the love

সর্বশেষ - বানিজ্য ও অর্থনীতি