ছেচল্লিশের ইতিহাস তুলে দাঙ্গায় উস্কানি বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে চলমান অশান্তির মধ্যে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সিনিয়র নেতা দিলীপ ঘোষের একটি বক্তব্য তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কলকাতার কাঁচড়াপাড়ায় এক জনসভায় তিনি হিন্দুদের আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র কেনার আহ্বান জানিয়েছেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও সম্প্রীতির ধারণার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তার এই বক্তব্যকে অনেকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উসকে দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন।
বক্তব্যের বিস্ফোরক অংশ
দিলীপ ঘোষ তার বক্তৃতায় ১৯৪৬ সালের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন, “গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময় সুরাবর্দি ও জ্যোতি বসুরা ধর্মতলায় শহিদ মিনারের নিচে লাল ও সবুজ ঝান্ডা বেঁধেছিলেন। তিন দিনে ৩০ হাজার হিন্দুকে হত্যা করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আজকের পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ।” তিনি দাবি করেন, মুর্শিদাবাদে হিন্দুদের বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়া হচ্ছে এবং কলকাতাকে ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে, যাতে কোনো হিন্দু পালাতে না পারে।
তিনি আরও বলেন, “সিদ্দিকুল্লা বলছে হাজার হাজার লোক রাস্তায় বসিয়ে জ্যাম করে দেবে। তখন আপনারা কী করবেন? পুলিশ খুঁজে পাবেন না। হিন্দুদের বাড়িতে টিভি, ফ্রিজ, আসবাব আছে, কিন্তু একটাও হাতিয়ার নেই। কিছু হলেই পুলিশের কাছে ছোটেন। পুলিশের কী দায়িত্ব আপনাদের বাঁচানো? ভগবানও দুর্বলের সঙ্গে থাকেন না। গোপাল পাঁঠার কথা কেন বারবার বলা হয়? তিনি খাসি কাটতেন, আর যারা খাসি খায় তাদেরও কাটতেন। হিন্দুদের এমন দুটো কাটার মতো লোক তৈরি হতে হবে।”
ধর্মনিরপেক্ষতা ও সম্প্রীতির সমালোচনা
দিলীপ ঘোষ ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে বলেন, “এরা আমাদের সেক্যুলারিজমের গুলি খাইয়েছে। সেলিম মোথাবাড়ি গিয়ে সম্প্রীতির মিছিল করছেন। হিন্দুরা মার খাচ্ছে, তাই সম্প্রীতির মিছিল হবে। মন্দির জ্বালানো হচ্ছে, তবু সম্প্রীতি করতে হবে? কে বলেছে হিন্দুদের সম্প্রীতি করতে হবে? সেক্যুলারিজমের গুলি খেয়ে ভারত দশভাগ হয়ে গেছে। ওপার বাংলায় এখনও ঘরবাড়ি লুট হচ্ছে, আর এখানে আমরা সম্প্রীতির গল্প শুনছি।”
তিনি পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দুদের ভারতে চলে আসার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, “যারা সাচ্চা হিন্দু ছিল, তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে এখানে এসেছিল। তারা লুঙ্গি পরে আসেনি, ধুতি পরে এসেছে। আমরা দেশ ছেড়েছি শান্তিতে থাকতে, হিন্দু হয়ে থাকতে। সেক্যুলার হতে হলে ওখানেই থাকতাম। ধর্ম আর পূর্বপুরুষের পরিচয়ের বিনিময়ে আমরা সম্প্রীতি করব না।”
কমিউনিস্টদেরও তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, “ওপারে মন্দির ভাঙা হচ্ছে, এপারেও মন্দির ভাঙা হচ্ছে। ওপার আর এপারের মধ্যে পার্থক্য কী? কমিউনিস্টরা তখন স্লোগান দিয়েছিল, ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম’। এখনও তারা সম্প্রীতি শেখাচ্ছে। এরা আমাদের সর্বনাশ করেছে। যে সম্প্রীতির কথা বলবে, তাকে সমাজবিরোধী, হিন্দু ও দেশের শত্রু বলে মনে করবেন।”
হিন্দু জাগরণ ও রামনবমীর উল্লেখ
দিলীপ ঘোষ হিন্দু জাগরণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বলেন, “দশ বছর আগে রামনবমীর শোভাযাত্রা শুরু হলে বাঙালি হিন্দুরা জানত না রামনবমী কী। আমরা হিন্দু জাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে কাজ শুরু করেছিলাম। আজ পাড়ায় পাড়ায় রামনবমী পালিত হচ্ছে। হিন্দুরা বুঝেছে, তাদের এক হয়ে বাঁচতে হবে।”
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
মুর্শিদাবাদে সাম্প্রতিক অশান্তি ও ওয়াকফ আইন নিয়ে বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপি নেতাদের বক্তব্য ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। কিছু নেতা মুর্শিদাবাদে হিন্দুদের বিরুদ্ধে হুমকির অভিযোগ তুলে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেছেন। দিলীপ ঘোষের এই বক্তব্য এই উত্তেজনাকে আরও তীব্র করেছে।
তার বক্তৃতায় ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার উল্লেখ এবং হিন্দুদের অস্ত্র কেনার আহ্বান সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির অভিযোগে সমালোচিত হচ্ছে। মুর্শিদাবাদে ইতোমধ্যে ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া
দিলীপ ঘোষের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। তৃণমূল কংগ্রেস ও বাম দলগুলো এটিকে সাম্প্রদায়িক উসকানি হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছে, এই ধরনের বক্তব্য পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে। সামাজিক মাধ্যমেও অনেকে তার বক্তব্যের নিন্দা করেছেন, আবার কেউ কেউ তার হিন্দু জাগরণের আহ্বানকে সমর্থন জানিয়েছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, দিলীপ ঘোষের এই বক্তব্য বিজেপির একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কৌশলের অংশ, যার মাধ্যমে হিন্দু ভোটকে একত্রিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে, এটি রাজ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করেছে।
আইনি ও সামাজিক প্রভাব
দিলীপ ঘোষের বক্তব্যের পর স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশের তৎপরতা বেড়েছে। তার বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, তার এই মন্তব্য পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।
মুর্শিদাবাদে ইতোমধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, এবং এই ধরনের বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করতে পারে। রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।