শনিবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৫| সন্ধ্যা ৭:১১

এখনো অজানা ১২১ শহীদের পরিচয়: বেওয়ারিশ কবরেই শেষ ঠিকানা

প্রতিবেদক
staffreporter
এপ্রিল ১৮, ২০২৫ ৮:০৭ অপরাহ্ণ
এখনো অজানা ১২১ শহীদের পরিচয়: বেওয়ারিশ কবরেই শেষ ঠিকানা

এখনো অজানা ১২১ শহীদের পরিচয়: বেওয়ারিশ কবরেই শেষ ঠিকানা

জুলাইয়ের রক্তাক্ত বিপ্লবে শহীদ হওয়া ১২১ জন অজ্ঞাতনামা মানুষের পরিচয় আজো অন্ধকারে। তাঁদের পরিবার, পরিচিতজন কিংবা কাছের কেউ জানে না—তাঁদের প্রিয় মানুষটি কোথায়, কেমন আছেন, বা আদৌ আছেন কি না। আর এই না জানার কষ্ট, বেদনা আর অসহায়তা যেন দীর্ঘতর হচ্ছে সময়ের সঙ্গে।
এই ১২১ জন শহীদের মধ্যে ১১৪ জনের মরদেহ ইতোমধ্যে রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমি কবরস্থানে দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। বাকি সাতটি মরদেহ এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে। কেউ এখনো এগিয়ে আসেননি তাঁদের সনাক্ত করতে।
রায়েরবাজার বধ্যভূমি কবরস্থানের ৪ নম্বর ব্লকের ৩৭ নম্বর লেনে চুপচাপ ঘুমিয়ে আছেন এই বেওয়ারিশ শহীদরা। প্রতিটি কব“এই কবরগুলোতে যারা চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন, তাদের সবার পিতৃপরিচয় ছিল, ছিল তাদের পরিবার; কিন্তু স্বৈরাচারী সরকারের কারণে তারা আজ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হলো। তারা তো বেওয়ারিশ ছিলেন না।”
এই কথাগুলো শুধু মাটি চাপা একেকটি শরীরের স্মৃতিচিহ্ন নয়, বরং রাষ্ট্রের ব্যর্থতার তীব্র নীরব সাক্ষ্য।
পরিচয় খুঁজছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
প্রত্যেকটি মরদেহের ডিএনএ নমুনা ও ছবি সংরক্ষণ করা হয়েছে, জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার এসএম মইনুল করিম। তিনি বলেন, “আপনাদের মাধ্যমে আমরা নিখোঁজদের স্বজনদের আহ্বান জানাতে চাই—এসে দেখুন, হয়তো কারো মুখে খুঁজে পাবেন নিজের হারিয়ে যাওয়া মানুষটিকে।”
ইতোমধ্যে যাত্রাবাড়ীর শহীদ রফিকুল ইসলামের পরিবার যোগাযোগ করেছে ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে। তাঁদের দাবি এখন যাচাই-বাছাই চলছে।
কিভাবে এল এই বেওয়ারিশ লাশগুলো?
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের হিসেব বলছে, শুধু জুলাই মাসেই তাঁরা ৮০টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছেন রায়েরবাজার কবরস্থানে, আগস্টে দাফন করা হয় আরও ৩৪টি। ১ জুলাই দাফন করা হয় ১০টি, ২২ ও ২৮ জুলাই ১১টি করে, ২৪ জুলাই ৯টি এবং ৮ ও ২৭ জুলাই ৭টি করে লাশ দাফন করা হয়।
এসব মরদেহ ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী, গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল এবং মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গ থেকে এসেছে। প্রতিটির শরীরে ছিল গুলির চিহ্ন, আঘাতের চিহ্ন, প্রতিবাদের ক্ষতচিহ্ন।
তাড়াহুড়োর দাফন, চাপের বাস্তবতা
আঞ্জুমানের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময় লাশগুলো খুব দ্রুত দাফনের জন্য গোয়েন্দা বাহিনীর পক্ষ থেকে আমাদের ওপর অনেক চাপ ছিল। আমাদের কোনো তদন্ত বা স্বজনদের অপেক্ষা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি।”
তাঁদের মতে, অধিকাংশ মরদেহ ছিল গুলিবিদ্ধ বা নির্মমভাবে আঘাতপ্রাপ্ত। অথচ পরিচয় না জানার কারণে কেউ আর জানে না—এই মানুষগুলোর স্বপ্ন কী ছিল, পরিবারের সদস্যরা কেমন করে তাঁদের জন্য অপেক্ষায় আছেন।
পরিচয়হীনতা যেন রাষ্ট্রের অপারগতা
একজন অপরাধ বিশ্লেষক, আহমেদ মারুফ বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত একটি ডেটাবেজ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে একটি স্থায়ী সেল গঠিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এসব মানুষের পরিচয় শনাক্ত কঠিন হবে। বিপ্লবের আট মাস পার হলেও এতগুলো শহীদের পরিচয় না পাওয়া সত্যিই লজ্জাজনক।”
তিনি আরও বলেন, “নিখোঁজদের পরিবার এখন একমাত্র ভরসা হিসেবে ডিএনএ পরীক্ষার দিকেই তাকিয়ে আছে।”
শেষ কথা
এই শহীদরা কোনোদিন বেওয়ারিশ ছিলেন না। রাষ্ট্র তাঁদের চিনতে পারেনি, কবরের বাঁশগুলোই এখন তাঁদের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের ঘরে কেউ হয়তো প্রতিদিন তাকিয়ে থাকেন দরজার দিকে, কেউ হয়তো এখনো ফোনের রিং শুনলে ছুটে আসেন—হয়তো তাঁর সেই ছেলে, ভাই, বাবা, বা স্বামী ফোন করছে। কিন্তু না, ফোন বাজে না আর। শুধু কবরের মাটি নিশ্চুপ থেকে বলে—“আমি আছি, তবু কেউ আমার নাম জানে না।”

মন্তব্য করুন
Spread the love

সর্বশেষ - বানিজ্য ও অর্থনীতি