বিডিআর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে প্রধান উপদেষ্টার জোরালো নির্দেশ
২০০৯ সালের ভয়াবহ বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস) হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের জন্য গঠিত তদন্ত কমিশনের কাজে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, “পুরো জাতি এই তদন্ত কমিশনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা সবাই উত্তর খুঁজছি। এই রহস্য উদঘাটন করতেই হবে, এবং কমিশনকে এই তদন্তে সফল হতেই হবে।”
বুধবার (১৬ এপ্রিল) বিকেল ৫টায় রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন যমুনায় তদন্ত কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এই মন্তব্য করেন। তিনি কমিশনকে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বপ্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বলেন, “এই হত্যাকাণ্ড ছিল অত্যন্ত নৃশংস। নিজেদের অফিসারদেরই তারা হত্যা করেছিল, এবং এটি অত্যন্ত মসৃণভাবে পরিকল্পিতভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। এমন ঘটনা শুধুমাত্র গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই সম্ভব।”
তদন্তে অগ্রগতি: জুনের মধ্যে প্রতিবেদন জমার প্রত্যাশা
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের তদন্তে পুরোদমে কাজ এগিয়ে চলছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আলম ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি, আগামী জুনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পারব। তবে, এটি ১৬ বছর আগের ঘটনা বলে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে কিছুটা সময় লাগছে। অভিযুক্তদের মধ্যে অনেকেই বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছি।”
কমিশন ইতোমধ্যে কারাগারে থাকা কয়েকজনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে। আলম ফজলুর রহমান জানান, “তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় ২৩ জন ব্যক্তি বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে ৮ জন সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য যোগাযোগ করেছেন। আমরা তাদের বক্তব্য গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছি।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এই হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের প্যাটার্ন নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত করছি। তথ্য-প্রমাণ থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রথমে ডিজি (মহাপরিচালক)-কে হত্যা করা হয়, এরপর বাকিদের হত্যা করা হয়। এটি স্পষ্টতই একটি গভীরভাবে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এমন ঘটনা সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছাড়া সম্ভব নয়।” তিনি এই ঘটনাকে ঐতিহাসিক ‘পলাশীর ষড়যন্ত্র’র সঙ্গে তুলনা করে বলেন, “এর শেকড় আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।”
তদন্তে ব্যর্থতার সমালোচনা
কমিশনের সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার এই হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সময়ে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “এত জঘন্য একটি হত্যাকাণ্ডের পরও একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারীকেও তৎকালীন সময়ে সরানো হয়নি, কাউকে দায়ী করা হয়নি। এটি গোয়েন্দা সংস্থা, সামরিক বাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি বিশাল ব্যর্থতা।”
তদন্ত কমিশনের গঠন ও কার্যক্রম
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য গঠিত কমিশনে মেজর জেনারেল (অব.) আলম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে আরও কয়েকজন বিশিষ্ট সদস্য রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোহন্য হলেন—ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাইদুর রহমান, মুন্সী আলাউদ্দিন আল আজাদ, ড. এম আকবর আলী, মো. শরীফুল ইসলাম, শাহনেওয়াজ খান চন্দন এবং এ টি কে এম ইকবাল। এই কমিশন বিভিন্ন সাক্ষী, অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট
২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ডে ৭৪ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে ৫৭ জন ছিলেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এত বছর পরও এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের মূল ষড়যন্ত্র এবং দায়ী ব্যক্তিদের পুরোপুরি চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। তদন্ত কমিশনের এই নতুন উদ্যোগের মাধ্যমে জাতি এই ঘটনার পেছনের সত্য উদঘাটনের প্রত্যাশা করছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের এই জোরালো নির্দেশনা এবং তদন্ত কমিশনের কার্যক্রম জাতির সামনে সত্য উন্মোচনের একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তবে, এই জটিল এবং স্পর্শকাতর ঘটনার তদন্তে কমিশন কতটা সফল হবে, তা নিয়ে জনমনে কৌতূহল এবং প্রত্যাশা বিরাজ করছে।