শনিবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৫| সকাল ৬:১২

মিয়ানমারে আটক ২০ বাংলাদেশি দেশে ফিরে স্বজনদের কাছে

প্রতিবেদক
staffreporter
এপ্রিল ১৬, ২০২৫ ৭:২৫ অপরাহ্ণ
মিয়ানমারে আটক ২০ বাংলাদেশি দেশে ফিরে স্বজনদের কাছে

মিয়ানমারে আটক ২০ বাংলাদেশি দেশে ফিরে স্বজনদের কাছে

মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক ২০ জন বাংলাদেশি নাগরিক দেশে ফিরেছেন। মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) তাদের বহনকারী বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ ‘বানৌজা সমুদ্র অভিযান’ চট্টগ্রামের বিএনএস ঈশা খান সমুদ্র জেটিতে পৌঁছায়। জাহাজে পৌঁছানোর পর তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। একই দিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একটি আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই নাগরিকদের তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এই ২০ জন বাংলাদেশি গত ১৩ এপ্রিল মিয়ানমার থেকে দেশের উদ্দেশে রওনা দেন। হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামান। এছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, ফিরে আসা নাগরিকদের পরিবারের সদস্যরা এবং স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে মো. কামরুজ্জামান বলেন, “এই প্রত্যাবাসন আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার একটি সফল ফল। বাংলাদেশ সরকার, মিয়ানমারে আমাদের দূতাবাস এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় এই নাগরিকদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। যারা এখনো বিদেশে বিপদে রয়েছেন, তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।”

তিনি আরও বলেন, “এই ঘটনা আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। অবৈধভাবে বা দালালদের মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এটি প্রায়ই দুঃখজনক পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। আমি দেশবাসীকে বৈধ ও নিরাপদ পথে বিদেশ গমনের জন্য সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।”

আটকের পটভূমি

মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, ফিরে আসা এই নাগরিকদের বেশিরভাগই অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর। অসাধু দালালরা তাদের মালয়েশিয়ায় পাচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মিয়ানমারে নিয়ে যায়। কিন্তু পথে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে আটক করে। দূতাবাস জানায়, এই নাগরিকদের বাংলাদেশি পরিচয় যাচাই এবং মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা হয়।

ফিরে আসা নাগরিকদের পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রিয়জনদের ফিরে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। একজন স্বজন বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম আর কখনো তাকে ফিরে পাব না। সরকার এবং দূতাবাসের প্রচেষ্টার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।” তবে অনেকে দালালদের প্রতারণার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

প্রত্যাবাসনের প্রেক্ষাপট

মিয়ানমারে বাংলাদেশি নাগরিকদের আটক এবং প্রত্যাবাসনের ঘটনা নতুন নয়। গত দুই বছরে মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাস মোট ৩৫২ জন বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। এর মধ্যে গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ৮৫ জন নাগরিকের প্রত্যাবাসন উল্লেখযোগ্য। দূতাবাস জানিয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই নাগরিকরা দালালদের প্রতারণার শিকার হয়ে অবৈধভাবে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

বাংলাদেশ সরকার এবং মিয়ানমারে দূতাবাস এই ধরনের ঘটনা রোধে এবং আটক নাগরিকদের ফিরিয়ে আনতে নিয়মিত কাজ করছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু প্রত্যাবাসনই যথেষ্ট নয়। অবৈধ অভিবাসন রোধে জনসচেতনতা বাড়ানো এবং দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

অবৈধ অভিবাসনের ঝুঁকি

অবৈধ পথে বিদেশ গমনের চেষ্টা বাংলাদেশে একটি চলমান সমস্যা। দরিদ্র এবং অশিক্ষিত পরিবারের তরুণরা প্রায়ই দালালদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পড়ে। মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপে ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে দালালরা তাদের বিপজ্জনক পথে নিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় অনেকে মৃত্যুবরণ করেন, আটক হন বা অমানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন।

প্রত্যাবাসিত কিশোরদের মধ্যে একজন বলেন, “আমাকে বলা হয়েছিল, মালয়েশিয়ায় ভালো চাকরি পাব। কিন্তু পথে আমরা ধরা পড়ি। জেলে দিন কাটানো খুব কষ্টের ছিল।” তিনি অন্যদের এই পথে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

সরকারি পদক্ষেপ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বাংলাদেশ সরকার অবৈধ অভিবাসন রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় জনসচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা চালাচ্ছে। এছাড়া বিদেশে আটক বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে দূতাবাসগুলো সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তবে স্থানীয় পর্যায়ে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠেছে।

এই প্রত্যাবাসন ঘটনা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কূটনৈতিক সম্পর্কের একটি ইতিবাচক দিক তুলে ধরেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে উত্তেজনা থাকলেও এই ধরনের সহযোগিতা দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনাকে জোরদার করে।

ফিরে আসা নাগরিকদের পুনর্বাসন এবং তাদের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন কাজ করছে। একই সঙ্গে সরকার এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে অবৈধ অভিবাসনের মূল কারণগুলো সমাধানের দিকে নজর দিচ্ছে।

এই প্রত্যাবাসন কেবল ২০ জনের দেশে ফেরা নয়, বরং হাজার হাজার পরিবারের জন্য একটি সতর্কবার্তা। বৈধ পথে এবং সচেতনতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিলে এমন ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব।

মন্তব্য করুন
Spread the love

সর্বশেষ - বানিজ্য ও অর্থনীতি