রাশিয়ার বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেনের হামলা, যুক্তরাষ্ট্রের নজর ইউক্রেনের বিদ্যুৎকেন্দ্রে
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপের পরপরই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রায় এক ঘণ্টার এই আলোচনা ছিল ফলপ্রসূ এবং ইতিবাচক বলে বর্ণনা করেছেন ট্রাম্প। তবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ইউক্রেনের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব এবং রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটিতে ইউক্রেনের ড্রোন হামলা।
হোয়াইট হাউস সূত্রে জানা গেছে, ট্রাম্প এবং জেলেনস্কির আলোচনায় ইউক্রেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মালিকানা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, তারা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আরও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে পারবে এবং ইউক্রেনের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। যদিও জেলেনস্কি স্পষ্ট জানিয়েছেন, রাশিয়ার দখলে থাকা জাপোরিঝিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া অন্য কোনো কেন্দ্রের মালিকানা হস্তান্তরের বিষয়টি বিবেচনাধীন নয়।
এদিকে জেলেনস্কি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ট্রাম্পের নেতৃত্বে চলতি বছরেই রাশিয়ার সঙ্গে একটি কার্যকর শান্তিচুক্তি হতে পারে। তবে আংশিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিষয়ে সতর্ক অবস্থানও তুলে ধরেন তিনি। যদি রাশিয়া এই চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে, তবে ইউক্রেন পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানাবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
ফোনালাপের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লেখেন, এই আলোচনার লক্ষ্য ছিল ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার উত্তেজনা প্রশমিত করা এবং দুই পক্ষের প্রয়োজন মেটানো। যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা সঠিক পথে এগোচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
এরই মধ্যে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে রাশিয়ার একটি কৌশলগত বিমানঘাঁটিতে ভয়াবহ ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবারের এই হামলায় রাশিয়ার সারাতোভ অঞ্চলের এঙ্গেলস বিমানঘাঁটিতে ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটে এবং আগুন ছড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হামলার পরপরই আশপাশের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, তারা ১৩২টি ইউক্রেনীয় ড্রোন ধ্বংস করেছে। তবে এঙ্গেলস ঘাঁটিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে তারা কোনো নির্দিষ্ট তথ্য জানায়নি। স্থানীয় গভর্নর রোমান বুসারগিন হামলার কথা স্বীকার করে বলেন, বিমানঘাঁটিতে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে জরুরি সেবা সংস্থাগুলো।
অন্যদিকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তাদের ড্রোন হামলায় বিমানঘাঁটির গোলাবারুদের গুদামে ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটে। এই ঘাঁটি থেকে রাশিয়া নিয়মিতভাবে ইউক্রেনের ওপর হামলা পরিচালনা করে বলে দাবি করেছেন ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা।
এটি প্রথমবার নয়, এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে একই ঘাঁটিতে ইউক্রেন ড্রোন হামলা চালিয়েছিল। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি তেল ডিপোতে হামলা চালায় তারা, যা থেকে এঙ্গেলস ঘাঁটিতে জ্বালানি সরবরাহ করা হতো। সেই হামলার পর তেল ডিপোটিতে পাঁচদিন ধরে আগুন জ্বলেছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলা ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরক্ষামূলক কৌশলের অংশ, যার মাধ্যমে রাশিয়ার সামরিক অবকাঠামোতে ধ্বংসাত্মক আঘাত হানতে চায় তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানিয়েছেন, ট্রাম্প ইউক্রেনকে অতিরিক্ত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছেন। দুই দেশের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের বিদ্যুৎ অবকাঠামো পুনর্গঠন ও বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন তিনি।
জেলেনস্কি অবশ্য স্পষ্ট করেছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মালিকানা হস্তান্তরের বিষয়টি কেবল জাপোরিঝিয়া কেন্দ্রের জন্য বিবেচিত হতে পারে, যা বর্তমানে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তার মতে, মার্কিন সহায়তা এই কেন্দ্রের নিরাপত্তা জোরদার করতে পারে এবং ইউক্রেনের জ্বালানি সংকট লাঘবে সহায়ক হবে।
তবে রাশিয়া এই প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র বলেছেন, এটি রাশিয়ার সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং রাশিয়া এমন যেকোনো পদক্ষেপের কঠোর জবাব দেবে।
বিশ্লেষকদের মতে, একদিকে ইউক্রেনের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার প্রস্তাব এবং অন্যদিকে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিতে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ—দুই ঘটনাই চলমান সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে। শান্তিচুক্তির সম্ভাবনা থাকলেও মস্কো এবং কিয়েভের অবস্থান এখনো পরস্পরের বিপরীতমুখী।
এমন পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে ইউক্রেনের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিয়ে চলমান বিতর্ক এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ এই যুদ্ধের পরবর্তী অধ্যায়ে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে, এমনটাই ধারণা করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।