সৈয়দপুরের গুলাহাট গণহত্যা: ইতিহাসের এক বিভীষিকাময় ১৩ জুন
১৯৭১ সালের ১৩ জুন দিনটি সৈয়দপুর শহরের ইতিহাসে এক ভয়াবহ ও কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এ দিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী বিহারী ও রাজাকার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে শহরের নিরীহ মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের ৪৭৮ জন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ‘ভারতে পৌঁছে দেওয়ার’ আশ্বাস দিয়ে তাদের ট্রেনে তুলে নেওয়া হয় এবং সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার উত্তরের প্রান্তে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। নারী, শিশু ও বৃদ্ধ—কাউকেই ছাড় দেওয়া হয়নি। সবকিছু লুটে নেওয়ার পর তাদের মৃতদেহ সেখানে ফেলে রেখে দেওয়া হয়।
এই হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাশাপাশি সরাসরি অংশ নেয় স্থানীয় উর্দুভাষী বিহারী জনগোষ্ঠী এবং বাঙালি রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনী। পরিকল্পিত এই অপারেশনের নাম ছিল ‘অপারেশন খরচাখাতা’, তবে ইতিহাসে এটি ‘গোলাহাট গণহত্যা’ নামে অধিক পরিচিত।
সৈয়দপুর ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে শহর ও ব্যবসায়িক কেন্দ্র। ব্রিটিশ ভারত বিভাজনের অনেক আগে থেকেই এখানে মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের বসবাস শুরু হয়। তারা স্থানীয়দের সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। উল্লেখযোগ্য দানবীরদের মধ্যে তুলসিরাম আগারওয়াল ছিলেন অন্যতম, যিনি তুলসিরাম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে নারীর শিক্ষায় অবদান রাখেন। তবে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরেও অনেক মাড়োয়ারি পরিবার সৈয়দপুরে থেকে যায়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈয়দপুর শহরের ৭৫ শতাংশ অধিবাসী ছিল উর্দুভাষী বিহারী মুসলমান, যারা সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেয় এবং স্থানীয় বাঙালিদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালায়। ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাসের কাছে পাকিস্তানি বাহিনী বিখ্যাত মাড়োয়ারি ব্যক্তিত্ব তুলসিরাম আগারওয়াল, যমুনাপ্রসাদ কেরিয়া ও রামেশ্বরলাল আগারওয়ালকে হত্যা করে। এরপর থেকে আতঙ্কিত মাড়োয়ারিদের বাড়িঘর, ব্যবসা ও দোকানে হামলা শুরু হয়।
১৩ জুন ঘটে যায় ইতিহাসের এক নির্মম ঘটনা। শুধু যে মানুষগুলো হত্যা করা হয় তা নয়, বরং এটি ছিল একটি সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ধ্বংসযজ্ঞ। সৈয়দপুরের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখা এই সম্প্রদায়ের মানুষজনের হত্যার মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী এক ভয়াবহ বার্তা দেয়।
গোলাহাট গণহত্যা আজও বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অপ্রতিস্পন্দিত কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত। এই গণহত্যার সঠিক বিচার ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো হয়নি, যা স্বাধীন বাংলাদেশের একটি অসমাপ্ত অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে।