তামাকের আগ্রাসনে বিপন্ন বাংলাদেশ: জরুরি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের ডাক
মানবদেহের জন্য চরম ক্ষতিকর হলেও বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে। প্রতিবছর এই বিষাক্ত উপাদানের কারণে প্রাণ হারাচ্ছেন দেড় লাখেরও বেশি মানুষ, আর পঙ্গুত্ব বরণ করছেন কয়েক লাখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় চার কোটি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি তামাক সেবনের কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এর বিস্তার ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে—১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সি ৯.২ শতাংশ শিশু-কিশোর তামাক ব্যবহার করে, যা একটি ভয়াবহ সামাজিক সংকেত।
মাদকবিরোধী সংস্থা মানসের তথ্যে জানা যায়, সিগারেটের ধোঁয়ায় রয়েছে সাত হাজারেরও বেশি বিষাক্ত রাসায়নিক, যার মধ্যে অন্তত ৭০টি ক্যানসারের কারণ। ১৫ বছরের নিচে চার লাখ ৩৫ হাজার শিশু তামাকজনিত নানা রোগে আক্রান্ত, যাদের বড় একটি অংশ ঘরে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। দেশে প্রতিবছর পরোক্ষ ধূমপানে মারা যায় প্রায় ২৬ হাজার অধূমপায়ী, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এসব পরিস্থিতি থেকে শিশু ও নারীদের রক্ষায় জরুরি উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে সংগঠনটি।
এই মারাত্মক পরিণতি সত্ত্বেও তামাক কোম্পানিগুলো নানা কৌশলে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এবারের ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০২৫’-এর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে—“তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি, তামাক ও নিকোটিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।” ২০২৩ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, সিগারেটের দামে বাংলাদেশ এখনো বিশ্বের অন্যতম সস্তা দেশ, ভারতের তুলনায় অনেক কম। এই মূল্য-সহজলভ্যতা তামাকসেবীদের সংখ্যা বাড়ানোর অন্যতম কারণ বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর মতে, দেশে বর্তমানে তামাকসেবীর সংখ্যা ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। এসব কোম্পানির প্রধান লক্ষ্য এখন তরুণ প্রজন্ম। আগের প্রজন্ম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করাই এখন তাদের প্রধান কৌশল। এজন্য তারা মোহনীয় বিজ্ঞাপনে ভর করে তরুণদের ফাঁদে ফেলে। যদিও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে সব ধরনের তামাক প্রচার, বিজ্ঞাপন ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ, তথাপি আইন বাস্তবায়নে ঘাটতির সুযোগে কোম্পানিগুলো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী তামাক কোম্পানির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ ও আইন সংশোধনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, তামাকজনিত মৃত্যুর দায় তারা কখনোই নেয় না, বরং নানা কূটকৌশলে ব্যবসা বাড়ায়। তিনি আসন্ন বাজেটে সিগারেটের নিম্ন ও মধ্যম স্তর একত্র করে মূল্যস্তরের সংখ্যা কমিয়ে আনার প্রস্তাব দেন।
প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, তামাকপণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে এতটাই কম যে এটি এখন নিত্যপণ্যের মতো সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। ফলে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোর করার পাশাপাশি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন ও মূল্যবৃদ্ধি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. রুমানা হক বলেন, তামাক শুধু জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি নয়, এসডিজি লক্ষ্য অর্জনেও বড় বাধা। তামাক চাষে ব্যবহৃত হচ্ছে বছরে এক লাখ একরেরও বেশি জমি, যা খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই কৃষির পথে বড় সংকট। বাজেট প্রভাবিত করতেও তামাক কোম্পানিগুলো নানা রাজনৈতিক ও মিডিয়া প্রভাব কাজে লাগায়, যা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা ও কঠোর আইন প্রয়োগ অপরিহার্য।
সব মিলিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই যদি রাষ্ট্র নীতিগতভাবে কঠোর না হয়, তাহলে আগামী প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে। তাই আইন সংশোধন, মূল্যবৃদ্ধি ও গণসচেতনতার সমন্বয়ে তামাক নির্মূলের বাস্তব ও কঠোর পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।