বাণিজ্য যুদ্ধের মধ্যে চীন বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনা বন্ধ করল
বিশ্বের দুই অর্থনৈতিক মহাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ নতুন মোড় নিয়েছে। চীন তার বিমান সংস্থাগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় বিমান নির্মাতা কোম্পানি বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে এনডিটিভি এই তথ্য জানিয়েছে। এই পদক্ষেপকে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্ক নীতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাণিজ্য যুদ্ধের পটভূমি
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে। ট্রাম্পের ঘোষিত ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছে। এর জবাবে চীনও মার্কিন পণ্যের উপর ১২৫ শতাংশ প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করেছে, যাকে বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ককে ‘বেআইনি’ বলে উল্লেখ করেছে।
এই শুল্কযুদ্ধের ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কে চরম অবনতি ঘটেছে। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের সাম্প্রতিক এই সিদ্ধান্ত বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনা বন্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বেইজিংয়ের কৌশলগত পদক্ষেপের একটি অংশ। এছাড়া, চীন তার বিমান সংস্থাগুলোকে মার্কিন কোম্পানিগুলো থেকে বিমান-সম্পর্কিত সরঞ্জাম এবং যন্ত্রাংশ কেনাও স্থগিত করতে বলেছে।
বোয়িংয়ের উপর প্রভাব
বোয়িং যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ শিল্পের একটি প্রধান স্তম্ভ এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিমান নির্মাতা কোম্পানি। চীন বোয়িংয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার, কারণ চীনের দ্রুত বর্ধনশীল বিমান চলাচল খাত বছরের পর বছর ধরে বোয়িংয়ের উড়োজাহাজের বড় ক্রেতা ছিল। চীনের এই সিদ্ধান্ত বোয়িংয়ের ব্যবসায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, চীন সরকার বোয়িং জেট ভাড়া করা বিমান সংস্থাগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তার পরিকল্পনা করছে, যাতে উড়োজাহাজ কেনা বন্ধ করার ফলে সৃষ্ট উচ্চ খরচের চাপ কমানো যায়। এই পদক্ষেপ চীনের বিমান চলাচল খাতের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ তারা বিকল্প উৎস থেকে উড়োজাহাজ সংগ্রহের দিকে ঝুঁকতে পারে, যেমন ইউরোপের এয়ারবাস বা চীনের নিজস্ব বিমান নির্মাতা কোম্পানি কম্যাক।
চীনের কৌশল
চীনের এই সিদ্ধান্তকে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বোয়িংয়ের মতো একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা স্থগিত করার মাধ্যমে চীন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে। বোয়িং শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি হাজার হাজার কর্মসংস্থানের সঙ্গেও জড়িত। চীনের এই পদক্ষেপ বোয়িংয়ের উৎপাদন ও বিক্রয়ে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ শিল্পের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
এছাড়া, চীনের এই সিদ্ধান্ত তার নিজস্ব বিমান নির্মাণ শিল্পকে উৎসাহিত করার একটি অংশ হতে পারে। চীনের কম্যাক কোম্পানি ইতিমধ্যে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ নির্মাণে কাজ করছে, এবং বোয়িংয়ের উপর নির্ভরতা কমানোর মাধ্যমে চীন তার দেশীয় শিল্পকে আরও শক্তিশালী করতে চাইছে।
বৈশ্বিক প্রভাব
ট্রাম্পের শুল্ক নীতি এবং চীনের প্রতিক্রিয়া বিশ্ব বাজারে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। শুল্কযুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হচ্ছে, এবং অনেক দেশ এই দুই মহাশক্তির মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে পড়ছে। ইউরোপ, এশিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলের দেশগুলো এই বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।
মার্কিন কংগ্রেসের কিছু সদস্য ইতিমধ্যে ট্রাম্পের শুল্ক নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা মনে করছেন, এই শুল্ক বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষতি করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব শিল্পের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বোয়িংয়ের ক্ষেত্রে চীনের সিদ্ধান্ত এই সমালোচনাকে আরও জোরালো করতে পারে।
চীনের বিমান চলাচল খাতের চ্যালেঞ্জ
চীনের বিমান চলাচল খাত বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল খাতগুলোর মধ্যে একটি। দেশটির ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং পর্যটন শিল্পের প্রসারের কারণে উড়োজাহাজের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। বোয়িংয়ের উপর নির্ভরতা কমানোর ফলে চীনকে বিকল্প উৎসের দিকে ঝুঁকতে হবে, যা তাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
ইউরোপের এয়ারবাস চীনের জন্য একটি সম্ভাব্য বিকল্প হলেও এয়ারবাসের উৎপাদন ক্ষমতা এবং ডেলিভারি সময়সূচি চীনের চাহিদা পূরণে সীমাবদ্ধতার মুখে পড়তে পারে। অন্যদিকে, চীনের নিজস্ব কম্যাক এখনো বোয়িং বা এয়ারবাসের মতো বিশ্বমানের উড়োজাহাজ উৎপাদনে পুরোপুরি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠেনি।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের এই পদক্ষেপ শুধু বোয়িংয়ের জন্যই নয়, বৈশ্বিক বিমান চলাচল শিল্পের জন্যও একটি টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ যদি আরও তীব্র হয়, তবে এটি অন্যান্য শিল্প এবং দেশগুলোর উপরও প্রভাব ফেলবে।
চীনের পক্ষ থেকে বোয়িংয়ের সঙ্গে ব্যবসা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত কূটনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান না হলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অনেকে মনে করছেন, আলোচনা ও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই সংকট নিরসনের চেষ্টা করা উচিত।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বোয়িংয়ের মতো একটি শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। চীনের এই সিদ্ধান্ত শুধু বোয়িংয়ের ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণই নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বিমান চলাচল শিল্পের উপরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। এই বাণিজ্য যুদ্ধ কোন দিকে যাবে, তা নির্ভর করছে দুই দেশের নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপের উপর। তবে এটি স্পষ্ট যে, এই উত্তেজনা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য একটি বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।