সারজিসের গাড়ির বহর নিয়ে তাসনিম জারার প্রশ্ন, পাল্টা জবাবে স্বচ্ছতার দাবি
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এর দুই শীর্ষ নেতা ডা. তাসনিম জারা ও সারজিস আলমের মধ্যে রাজনৈতিক বিতর্ক নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। সম্প্রতি সারজিস আলম পঞ্চগড়ে তার নিজ এলাকায় শতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে শোডাউন করেন, যা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠে আসে। এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ডা. তাসনিম জারা ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে সরাসরি এই আয়োজনের আর্থিক উৎস এবং দলীয় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ডা. তাসনিম জারা তার পোস্টে লেখেন, “তুমি কিছুদিন আগেই প্রকাশ্যে বলেছিলে, আমার আসলে এই মুহূর্তে কোনও টাকা নেই। ধার করে চলছি। এইটাই হচ্ছে রিয়্যালিটি। আমার পকেটে মানিব্যাগও নেই। তোমার এই সাদাসিধে জীবনযাত্রার কথা আমাদেরকে অভিভূত করেছিলো এবং জনগণের কাছে আমাদের সংগ্রামকে আরও গ্রহণযোগ্য করেছে।”
তিনি আরও লেখেন, “এরপর এত বড় একটি বহর নিয়ে শোডাউন কীভাবে সম্ভব হলো, তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। আমাদের দল স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাই এই প্রশ্নের স্পষ্ট ও নির্ভরযোগ্য উত্তর দেওয়া জরুরি।”
এই পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর এনসিপি কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। অনেকে তাসনিম জারার পক্ষ নিয়ে সারজিসের শোডাউনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, আবার কেউ কেউ সারজিসের কর্মকাণ্ডকে রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশ বলে অভিহিত করেছেন।
এদিকে, ডা. তাসনিম জারার এই পোস্টের জবাবে সারজিস আলম ফেসবুকে পাল্টা পোস্ট দিয়ে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “গাড়ির ভাড়া দিতে যা খরচ হয়েছে, তা দেওয়ার সামর্থ্য আমার পরিবারের আরও ৫০ বছর আগেও ছিল। আমার দাদা আমার জন্য যা রেখে গেছেন, তা দিয়ে আমি আমার নির্বাচনও করে ফেলতে পারবো।”
সারজিসের মতে, রাজনীতিতে ফেসবুকের বিতর্ক আর বাস্তবতা এক নয়। তিনি বলেন, “মাঠের রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য শক্তি ও সামর্থ্য প্রয়োজন। প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করার সক্ষমতা না থাকলে, সাধারণ জনগণও আপনাকে গোনায় ধরবে না।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা নতুন বন্দোবস্ত চাই, কিন্তু সেটা কখনও ছয় মাসের ব্যবধানে ১৮০ ডিগ্রি উল্টে যাবে না। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ১০, ২০, ৩০ শতাংশ পরিবর্তিত হবে। একসময় শতভাগ নতুন বন্দোবস্ত দেখতে পাবো।”
তবে সারজিসের এই ব্যাখ্যাও বিতর্কের ইতি টানতে পারেনি। অনেকেই মনে করছেন, এই মন্তব্য দলের ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার’ প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাসনিম জারাও তার পোস্টে স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, বরং দলীয় নীতিমালার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই এই প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো জনগণের আস্থা অর্জন করা। জনগণের আস্থার সঙ্গে আপস করে আমরা কোনো অবস্থান গ্রহণ করতে পারি না। সারজিস যদি স্বচ্ছতা বজায় রেখে এর অর্থনৈতিক উৎস ব্যাখ্যা করেন, তাহলে তা দলের ভাবমূর্তি আরও সুসংহত করবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনাটি এনসিপির অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চারই একটি প্রতিফলন। তারা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যখন প্রশ্ন তোলা মানেই দল থেকে বহিষ্কার কিংবা হুমকির মুখোমুখি হওয়া, সেখানে তাসনিম জারার প্রশ্ন তোলা এবং সারজিসের জবাব দেওয়া একটি ইতিবাচক দিক।
তবে, সাধারণ জনগণ এই বিতর্কের একটি স্পষ্ট জবাব আশা করছে। রাজনৈতিক দলের কাছে তারা কেবল ভাষণ নয়, বরং কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা দেখতে চায়। এনসিপি যদি সত্যিই ভিন্নধর্মী রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, তবে এই বিতর্কের সঠিক ও জবাবদিহিমূলক সমাধান দলটির জন্য এক সত্যমিথ্যার পরীক্ষা।
ফেসবুক বিতর্কের পাশাপাশি এনসিপির অভ্যন্তরীণ আলোচনায়ও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। দলীয় নেতারা মনে করছেন, এ ধরনের প্রকাশ্য বিতর্ক দলকে একদিকে যেমন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে, তেমনি স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার সুযোগও তৈরি করেছে।
এনসিপির কর্মী-সমর্থকরা সারজিস আলম ও ডা. তাসনিম জারার কাছ থেকে আরও স্পষ্ট ব্যাখ্যা আশা করছেন। একই সঙ্গে তারা দলীয় নীতিমালার ভিত্তিতে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ দেখতে চান, যাতে এনসিপির ‘ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ গড়ার প্রতিশ্রুতি প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই বিতর্ক কি সত্যিই কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করবে, নাকি এটি কেবল আরেকটি বিতর্ক হিসেবেই থেকে যাবে, তা সময়ই বলে দেবে।