গাজা পুনর্গঠনে মিশরের পরিকল্পনায় রাজি আরব বিশ্ব, হামাসের হুঁশিয়ারি ও ইসরায়েলের নিন্দা
গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিতে এগিয়ে এসেছে মিশরসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশ। একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা সামনে এনেছে মিশর, যেখানে ৫৩ বিলিয়ন ডলারের বাজেট ধরে গাজায় নতুন আবাসন, প্রযুক্তি হাব, বাণিজ্যিক বন্দর, এবং সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন হোটেল নির্মাণের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। তবে এই পরিকল্পনা ঘিরে দারুণ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। একদিকে হামাস বলছে, তারা কোনো বাইরের চাপিয়ে দেওয়া সমাধান মেনে নেবে না, অন্যদিকে ইসরায়েল এই পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করে বলেছে, এটি বাস্তব পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করেছে।
গত ১৫ মাস ধরে ইসরায়েল-হামাস সংঘাত গাজার জনজীবনকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে। ধ্বংসযজ্ঞের পর গাজার ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি নিয়ে বহু আলোচনা চলছিল। মিশরের এই পরিকল্পনাকে অনেকেই একটি সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে দেখলেও হামাস স্পষ্ট করে জানিয়েছে, তারা গাজায় কোনো বিদেশি প্রশাসন বা বাহিনী চায় না। হামাসের সিনিয়র নেতা সামি আবু জুহরি বলেছেন, “আমরা কোনো বাইরের প্রশাসন বা বিদেশী বাহিনীর উপস্থিতি বরদাশত করব না।”
এদিকে, আরব দেশগুলোর একটি অংশ এই পরিকল্পনাকে সমর্থন জানিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সহায়তা চেয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে ইসরায়েল কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “এই পরিকল্পনা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। হামাসের সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং আমাদের নাগরিকদের হত্যা ও অপহরণের বিষয়টি এতে উপেক্ষা করা হয়েছে।” ইসরায়েল আরও বলেছে, তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফিলিস্তিনিদের গণ-উচ্ছেদের ধারণাকে সমর্থন করে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের মিশর ও জর্ডানে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
মিশরের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, গাজায় বর্তমানে হামাসের যে প্রশাসন চলছে, সেটিকে সরিয়ে একটি ‘গভর্নেন্স অ্যাসিস্ট্যান্স মিশন’ গঠন করা হবে। এই মিশন সাময়িকভাবে দায়িত্ব নিয়ে গাজার পুনর্গঠন এবং মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। তবে এর বিরোধিতা করেছে হামাস। তারা মনে করছে, এটি তাদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য একটি বিদেশি ষড়যন্ত্র।
গাজার পুনর্গঠনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে। যদিও মিশরের পরিকল্পনায় এই অর্থ কোথা থেকে আসবে তা স্পষ্ট নয়, তবে ধারণা করা হচ্ছে, উপসাগরীয় দেশগুলোর থেকে সহায়তা নিয়ে এই ২০ বিলিয়ন ডলার পূর্ণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। আমিরাত ইতোমধ্যেই হামাসকে অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখে এবং গাজার সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ চায়। অন্যদিকে, অন্যান্য আরব দেশগুলো ধাপে ধাপে নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে বলে জানা গেছে।
গাজার এই পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি ট্রাম্পের ‘রিভিয়েরা অব দ্য মিডল ইস্ট’ ধারণাকে আরব দেশগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। ট্রাম্পের এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে সরিয়ে জর্ডান ও মিশরে পুনর্বাসন করা। আরব রাষ্ট্রগুলো এটিকে তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে এবং দৃঢ়ভাবে এর বিরোধিতা করছে।
এদিকে ইসরায়েলের নিন্দার পেছনে মূলত দুটি বিষয় রয়েছে—এক, তারা হামাসকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে চায় এবং দুই, তারা চায় না যে গাজার পুনর্গঠনে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ কোনো ভূমিকা রাখুক। ইসরায়েল বরাবরই ইউএনআরডব্লিউএ-কে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সহায়তা দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করে আসছে।
বর্তমানে গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে একাধিক পক্ষের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। একদিকে মিশর ও কিছু আরব দেশ নতুন একটি প্রশাসনের মাধ্যমে গাজাকে পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করছে, অন্যদিকে হামাস নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলও চাচ্ছে না যে, গাজায় এমন কোনো সমাধান আসুক যা তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে।
এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে গাজার পুনর্গঠন কবে শুরু হবে এবং কিভাবে হবে, সেটি এখনো অনিশ্চিত। তবে এটি স্পষ্ট যে, মধ্যপ্রাচ্যের এই ছোট ভূখণ্ডটি শুধু একটি পুনর্গঠনের প্রশ্ন নয়, বরং এটি এখন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি বড় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।