ইন্দো-প্যাসিফিকে সামরিক শক্তি প্রদর্শন করছে চীন, আঞ্চলিক দেশগুলোতে উদ্বেগ
গত সপ্তাহে তাইওয়ান প্রণালি থেকে তাসমান সাগর পর্যন্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ধারাবাহিক সামরিক মহড়া চালিয়েছে চীন। অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ পরিচালিত এই মহড়াকে বিশেষজ্ঞরা ‘সামরিক সক্ষমতার প্রদর্শনী’ হিসেবে দেখছেন। পাশাপাশি, তারা বলছেন, এই মহড়ার মাধ্যমে আমেরিকা ও আঞ্চলিক দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করেছে বেইজিং।
টোকিও ইন্টারন্যাশনাল ক্রিস্টিয়ান ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ স্টিফেন ন্যাগি বলেছেন, চীন এই সামরিক মহড়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করছে। তিনি বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসন বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটসহ অন্যান্য বৈশ্বিক ইস্যুতে ব্যস্ত, যা চীনকে ইন্দো-প্যাসিফিকে শক্তি প্রদর্শনের কৌশলগত সুযোগ করে দিচ্ছে।”
ন্যাগি আরও বলেন, “যেখানে আমেরিকা মনোযোগ দেবে না, সেখানে চীন তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে।” ফলে এই মহড়া শুধু শক্তি প্রদর্শন নয়, বরং আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারেরও কৌশল।
গত বুধবার পিপলস লিবারেশন আর্মি (PLA) তাইওয়ানের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরের জলসীমায় যুদ্ধ মহড়া চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় তাইওয়ান সরকার তাদের সামরিক বিমান ও নৌবাহিনীর জাহাজ মোতায়েন করে।
তাইপে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চীনের এ ধরনের বিনা নোটিসে চালানো সামরিক মহড়া তাদের বাণিজ্যিক বিমান ও জাহাজ চলাচলের জন্য হুমকি। শুধু তাই নয়, তাইওয়ানের কাছাকাছি চীনের ৪৫টি সামরিক বিমান এবং ১৪টি নৌযানও মোতায়েন করা হয়েছিল।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “উপকূল থেকে মাত্র ৪০ নটিক্যাল মাইল দূরে এভাবে যুদ্ধের অনুশীলন স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক নিয়মের লঙ্ঘন।”
তবে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই মহড়াকে ‘নিয়মিত প্রশিক্ষণ’ বলে দাবি করেছে। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র উ চিয়ান বলেন, “তাইওয়ানের সমালোচনা অতিরঞ্জিত। তারা যেন অহেতুক দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা না করে।”
চীন শুধু তাইওয়ান প্রণালিতেই নয়, ভিয়েতনামের কাছে টনকিন উপসাগর এবং অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের কাছে তাসমান সাগরেও সামরিক মহড়া চালিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাসমান সাগরের মহড়া সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ তৈরি করেছে, কারণ চীনা নৌযানগুলো উন্নত জাহাজবিধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে সেখানে মহড়া চালিয়েছে। নিউজিল্যান্ডের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জুডিথ কলিন্স বলেন, “চীনের এই অস্ত্র দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় আঘাত হানা সম্ভব, অথচ তারা আমাদের কোনো সতর্কবার্তা দেয়নি।”
নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইন্সটান পিটার্স চীনের এই মহড়াকে ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যর্থতা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বেইজিংয়ে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ঈ-কে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, নিউজিল্যান্ড আশা করে চীন ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকবে।
তবে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে বিষয়টি অতিরঞ্জিত করছে। তারা বলেছে, “চীনের নিয়মিত সামরিক মহড়াকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করা অগ্রহণযোগ্য।”
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের এই মহড়া শুধু শক্তি প্রদর্শনের জন্য নয়, বরং তারা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রতিরক্ষা কৌশলও যাচাই করছে। পেন্টাগনের সাবেক কর্মকর্তা ড্রু থমসন বলেন, “চীনের এই আগ্রাসন প্রতিহত করতে আঞ্চলিক দেশগুলোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এখন তাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, “যুক্তরাষ্ট্র যদি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মনোযোগ না দেয়, তাহলে চীন তার স্বল্পমেয়াদি সামরিক মহড়া চালিয়ে যাবে। আর তা হবে পূর্বঘোষিত ছাড়াই।”
এই পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক দেশগুলো নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি চীনের আগ্রাসী আচরণ নথিভুক্ত করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রচার করার দিকে নজর দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।