গাজায় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, গণহত্যার দ্বিতীয় ধাপের শঙ্কা!
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানকে নজিরবিহীন মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। জেনেভায় মানবাধিকার কাউন্সিলে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। একইসঙ্গে হামাসের যুদ্ধাপরাধের দিকেও তিনি ইঙ্গিত করেছেন।
ওএইচসিএইচআরের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, হামাস ৭ অক্টোবরের হামলায় ইসরায়েলি ভূখণ্ডে নির্বিচারে রকেট হামলা চালিয়েছে, যা যুদ্ধাপরাধের শামিল। ইসরায়েলের পরিসংখ্যান অনুসারে, হামলায় ১২০০ ইসরায়েলি নিহত হয় এবং ২৫০ জনের বেশি জিম্মি হয়। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজায় ভয়াবহ হামলা চালিয়ে ৪৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। শহরজুড়ে ধ্বংসস্তূপ, হাসপাতাল, স্কুল, ঘরবাড়ি—সবকিছুই ইসরায়েলি আগ্রাসনের শিকার।
ইসরায়েল এই প্রতিবেদন নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, কাউন্সিলে তাদের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল না। চিলির প্রতিনিধি বিষয়টিকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে বরাবরের মতোই ইসরায়েল তাদের অভিযানকে ‘হামাসকে নির্মূল করার প্রয়াস’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে দাবি করেছে, তারা বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা কমানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
গাজায় চলমান এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেই ইসরায়েলে নতুন করে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে বলে দাবি করছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) উত্তর ইসরায়েলের কারকুর জংশনে একটি বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি হামলায় ১৪ জন আহত হয়েছে। ইসরায়েলি পুলিশের গুলিতে হামলাকারী নিহত হয়েছে। পুলিশের দাবি, এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত হামলা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দ্রুতগতির একটি গাড়ি মানুষের ভিড়ের দিকে ছুটে যায়, তারপরই নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালায়।
এই ঘটনার মধ্যে মিশরের রাজধানী কায়রোতে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা চলছে। ইসরায়েল প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর পক্ষে, যেখানে প্রতি সপ্তাহে তিনজন ইসরায়েলি বন্দি মুক্তির শর্তে ফিলিস্তিনি বন্দিদের ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। তবে হামাস এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। যদি আলোচনা সফল হয়, তাহলে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে সাময়িক শান্তি আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে যুদ্ধবিরতির আড়ালে কী হচ্ছে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আইসিজে মনে করছে, ইসরায়েল মূলত নতুন করে গণহত্যার পরিকল্পনা করছে এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে মিথ্যা প্রচারণার আশ্রয় নিচ্ছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমও ইসরায়েলের প্রপাগান্ডার অংশ হয়ে উঠেছে।
ইসরায়েল দাবি করেছিল, হামাস ৭ অক্টোবরের হামলায় শিশুদের শিরশ্ছেদ করেছে, দলবেঁধে ধর্ষণ করেছে—কিন্তু এর কোনো প্রমাণ মেলেনি। বরং হামাসের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ইসরায়েল ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছে। পশ্চিম তীরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করেছে, যাকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো ‘জাতিগত নির্মূলকরণ’ হিসেবে বর্ণনা করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল এখন প্রচারযুদ্ধে হেরে যাচ্ছে বলেই নেতানিয়াহু গণহত্যার নতুন ধাপ শুরু করতে চাচ্ছেন। বন্দি বিনিময়ের চুক্তি করেও তিনি যুদ্ধবিরতি স্থায়ী করতে রাজি নন। বরং যুদ্ধবিরতি ভেঙে ফের হামলা শুরুর জন্য অজুহাত খুঁজছেন।
গাজার জনগণকে ১৭ বছর ধরে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ইসরায়েলের লক্ষ্য এখানে কেবল হামাসকে ধ্বংস করা নয়, বরং পুরো ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা। বন্দি বিনিময়কেও নেতানিয়াহু কৌশলগতভাবে ব্যবহার করছেন, যাতে নতুন করে গণহত্যার পথ তৈরি করা যায়।
বিশ্ববাসীর চোখের সামনেই গণহত্যা চলছে, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের গণমাধ্যম ইসরায়েলকে দায়মুক্তি দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি এখনই জোরালো পদক্ষেপ না নেয়, তবে গাজায় আরেকটি ভয়াবহ গণহত্যা দেখার জন্য বিশ্বকে প্রস্তুত থাকতে হবে।