সমুদ্রের নিচে হারিয়ে যাওয়া পৌরাণিক নগরী: দ্বারকার রহস্য
পৌরাণিক কাহিনি ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সংযোগস্থলে এক রহস্যময় নগরী দাঁড়িয়ে আছে—দ্বারকা, যা হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে বিবেচিত। মহাভারতে এই শহরকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাজ্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা একসময় সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। যুগ যুগ ধরে এটি কেবলই একটি কিংবদন্তি হিসেবে গণ্য হলেও, আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা বলছে, হয়তো সত্যিই একসময় দ্বারকা অস্তিত্বশীল ছিল।
২০০১ সালে ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওশানোগ্রাফি (NIO) গুজরাট উপকূলের কাছে আরব সাগরের নিচে এক রহস্যময় ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে। প্রায় ৪০ মিটার গভীরে পাওয়া যায় সুবিন্যস্ত প্রাচীর, রাস্তাঘাট ও ভবনের ধ্বংসাবশেষ, যা এক সময়কার সমৃদ্ধ নগরীর প্রমাণ দেয়। প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এটি প্রায় ৯০০০ বছরের পুরনো বলে ধারণা করা হয়, যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার।
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, শ্রীকৃষ্ণ যখন কংসকে হত্যা করে মথুরার সিংহাসনে বসেন, তখন মথুরা বারবার শত্রুদের আক্রমণের শিকার হয়। তখন তিনি মথুরা ছেড়ে দ্বারকা নামে এক নতুন নগরী প্রতিষ্ঠা করেন, যা আধুনিক গুজরাটের উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। দ্বারকাকে তিনি সুরক্ষিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলেন, যার চারপাশে শক্তিশালী দুর্গ ও সুপরিকল্পিত রাস্তা ছিল। কিন্তু কৃষ্ণের মৃত্যুর পর, পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, দ্বারকা ধীরে ধীরে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
আধুনিক গবেষণা ও সমুদ্রতল থেকে সংগৃহীত নিদর্শনগুলো এই পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে মিল রেখে দ্বারকার বাস্তবতা সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন, এটি হয়তো সত্যিই প্রাচীন এক সভ্যতার অংশ ছিল, যা কোনো এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। সমুদ্রের নিচে পাওয়া কাঠামোগুলো অত্যন্ত সুসংগঠিত, যা তখনকার সময়ের নগর পরিকল্পনার নিদর্শন হতে পারে।
কিছু গবেষক মনে করেন, দ্বারকার এই ধ্বংসাবশেষ সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক কোনো নগরীর অংশ হতে পারে, যা কোনো বড় ভূমিকম্প বা সুনামির ফলে তলিয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এটি পৌরাণিক কাহিনির উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া অতিরঞ্জিত গল্প মাত্র। তবে নিঃসন্দেহে, এই রহস্যময় নগরীর সন্ধান মানব সভ্যতার ইতিহাসকে নতুন করে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করবে।
এই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। আধুনিক সোনার স্ক্যানিং, ডুবুরি অনুসন্ধান এবং ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ একদিন হয়তো এই পৌরাণিক নগরীর প্রকৃত সত্য উন্মোচন করতে সক্ষম হবে। দ্বারকার এই রহস্য ভবিষ্যতে আরও নতুন আবিষ্কারের দুয়ার খুলতে পারে, যা প্রমাণ করবে যে আমাদের ইতিহাসে অনেক কিছুই এখনো অজানা রয়ে গেছে।