মানবসভ্যতার হারিয়ে যাওয়া শহর: রহস্যময় মহেঞ্জোদারো
মহেঞ্জোদারো—একটি প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন, যার ইতিহাস আজও রহস্যে ঘেরা। প্রায় ৪,৫০০ বছর আগের এই শহর ছিল সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম বৃহৎ কেন্দ্র। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক আর.ডি. ব্যানার্জি যখন পাকিস্তানের সিন্ধু অঞ্চলে খনন কাজ শুরু করেন, তখন তিনি এই বিস্ময়কর নগরীর সন্ধান পান। শহরটি ছিল সুচারুভাবে পরিকল্পিত, যেখানে প্রশস্ত সড়ক, বহুতল ভবন এবং উন্নত নিকাশী ব্যবস্থা ছিল, যা আধুনিক নগর পরিকল্পনার অন্যতম নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর নগর ব্যবস্থাপনা। বিশাল কাঁদামাটির ইট দিয়ে নির্মিত বাড়িঘর, গোসলের জায়গা, বাজার এবং একটি সুসংগঠিত জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, মহেঞ্জোদারোর সমাজ ছিল সমৃদ্ধ, যেখানে বাণিজ্য, কৃষি ও শিল্পের সমন্বয় ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া বিভিন্ন শিল্পকর্ম এবং সীলমোহর থেকে বোঝা যায়, এখানকার মানুষ সুসজ্জিত পোশাক পরিধান করত, অলংকার ব্যবহার করত এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে দূরবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল।
তবে সবচেয়ে রহস্যজনক দিক হলো শহরটির ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণ। কীভাবে এত উন্নত একটি নগরী একসময় পরিত্যক্ত হয়ে গেল, তা নিয়ে নানা গবেষণা হয়েছে। কেউ বলেন, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ—যেমন ভয়াবহ বন্যা বা ভূমিকম্প—এটিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। আবার কেউ বলেন, শত্রুরা আক্রমণ করেছিল এবং এই মহানগরীকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। কিছু বিশেষজ্ঞ এমনকি মনে করেন, মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসের পেছনে ছিল পারমাণবিক বিস্ফোরণের মতো এক অজানা শক্তি, কারণ শহরের কিছু স্থানে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদিও এই দাবির পক্ষে নিশ্চিত প্রমাণ নেই, তবে এটি এক ধরনের কল্পনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, মহেঞ্জোদারোর অধিবাসীদের জীবনধারা সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায়নি। এখানকার লিপি এখনো পুরোপুরি উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি, যার ফলে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া কঠিন। তবুও, এই সভ্যতার শিল্পকর্ম, স্থাপত্য ও পরিকল্পনা দেখে অনুমান করা যায় যে এটি ছিল এক উন্নত নগর, যেখানে ছিল শক্তিশালী প্রশাসন এবং উন্নত জীবনব্যবস্থা।
আজ মহেঞ্জোদারো শুধুমাত্র একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নয়, এটি মানবসভ্যতার ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অংশ। এর ধ্বংসাবশেষ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, কালের বিবর্তনে কত সমৃদ্ধ নগরী বিলীন হয়ে গেছে, এবং আমাদের আধুনিক সভ্যতাও একদিন হয়তো একই ভাগ্যবরণ করতে পারে।
4o