পানাম নগর: এক বিস্মৃত স্বর্ণযুগের নীরব স্বাক্ষী
বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত প্রাচীন পানাম নগর একটি বিস্মৃত স্বর্ণযুগের নিদর্শন। একসময়ের সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই নগরী আজ পরিণত হয়েছে একটি প্রাচীন নিদর্শনভূমিতে। শতাব্দী প্রাচীন এই শহরের প্রতিটি ইট, দেয়াল এবং সরু পথ যেন তখনকার ইতিহাসের গল্প শোনায়। পানাম নগর শুধু স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য উদাহরণ নয়, বরং এটি একটি হারিয়ে যাওয়া সময়ের পরিচায়ক, যা বাংলার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গৌরবের প্রতীক।
পানাম নগরের ইতিহাস শুরু হয় প্রায় ১৫ শতকে, যখন সোনারগাঁও ছিল বাংলার রাজধানী এবং মুসলিম শাসকদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র। মুঘল আমলে পানাম নগর হয়ে ওঠে একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র, যেখানে বস্ত্রশিল্প ছিল প্রধান আকর্ষণ। এখানকার সূতিবস্ত্র বিশেষ করে মসলিন, বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত ছিল। পানাম নগরের রাস্তা এবং ভবনগুলো সেই সমৃদ্ধ সময়ের সাক্ষী, যখন বণিকদের আনাগোনায় এ অঞ্চল সরব থাকত।
পানাম নগরের স্থাপত্য শৈলীতে মিশে আছে মুঘল, ব্রিটিশ এবং বাংলা সংস্কৃতির সম্মিলন। এখানে প্রায় ৫২টি প্রাচীন ভবনের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যা একসময় বাংলার ধনী ব্যবসায়ী এবং জমিদারদের বাসস্থান ছিল। প্রতিটি ভবনের নকশায় রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ, যা বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার উজ্জ্বল নিদর্শন। পানাম নগরের সরু রাস্তাগুলোতে হাঁটলে মনে হয় যেন সময় স্থির হয়ে আছে, এবং চারপাশের প্রতিটি দেয়াল আপনাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়।
তবে সময়ের সাথে সাথে পানাম নগরের গৌরব বিলীন হয়ে গেছে। ১৯ শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশ শাসন এবং স্থানীয় প্রশাসনিক পরিবর্তনের কারণে পানাম নগর ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে পড়ে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর এটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। বর্তমানে, এটি একটি পরিত্যক্ত শহর, যা ধীরে ধীরে প্রকৃতির করালগ্রাসে হারিয়ে যেতে বসেছে।
পানাম নগর আজ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও সংরক্ষণের কাজ চলছে, যাতে এই ঐতিহাসিক স্থানটির গুরুত্ব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। পর্যটকদের জন্য এটি একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য, যেখানে ইতিহাসের স্পর্শ অনুভব করা যায়। কিন্তু এটি সংরক্ষণের অভাবে দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পানাম নগর শুধুমাত্র একটি প্রাচীন নগরী নয়; এটি বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য প্রতীক। এটি আমাদের ইতিহাসের একটি অমূল্য অংশ, যা আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনধারা এবং সময়ের পরিবর্তনের গল্প বলে। এই শহরটি সংরক্ষণ এবং এর হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলো পুনরুদ্ধার করা আমাদের সবার দায়িত্ব, যাতে এই স্থাপনাটি ভবিষ্যতের জন্য অমর হয়ে থাকে।