ঐতিহাসিক শশীলজ: প্রাসাদ থেকে জাদুঘরে ময়মনসিংহের অতীত ঐতিহ্য
ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে, ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী প্রাসাদ ‘শশীলজ’ কেবল একটি স্থাপত্য নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। ইউরোপীয় ধাঁচে নির্মিত এই প্রাসাদ একসময় ছিল জমিদারদের শৌর্য-বীর্য ও শিল্পরুচির প্রতীক। এখন এটি ময়মনসিংহ জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং স্থানীয় ও বিদেশি দর্শনার্থীদের কাছে ইতিহাস অনুধাবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে উঠেছে।
শশীলজ নির্মাণ করেছিলেন মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরীর দত্তকপুত্র মহারাজ শশীকান্ত আচার্য্য চৌধুরী। কথিত আছে, মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি থেকে এই প্রাসাদ পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গপথ ছিল। মূলত এটি ছিল একটি দোতলা ভবন, যার নির্মাণে ব্যবহৃত হয় ইউরোপ ও প্যারিস থেকে আমদানি করা দামী উপকরণ। মেঝেতে মার্বেল, জানালায় রঙিন কাঁচ, ছাদে ঝাড়বাতি, ভেতরে ঝরনা ও বলরুম—সবকিছুই ছিল অতুলনীয় অভিজাত্যের নিদর্শন। কিন্তু ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনটি বিধ্বস্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সালের মধ্যে মহারাজ শশীকান্ত নতুন করে এটি নির্মাণ করেন।
প্রবেশপথের তোরণ, সবুজ লনের মাঝে মার্বেল ঝরনা ও ভাষ্কর্য, পুরনো পুকুর আর তার ঘাটে নির্মিত স্নানঘর—সবকিছুই আজও জমিদার আমলের আভিজাত্য বহন করে। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে এবং বর্তমানে এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এই জাদুঘরে জমিদার আমলের বহু দুর্লভ নিদর্শন ও শিল্পকর্ম সংরক্ষিত আছে। রয়েছে বিভিন্ন জমিদারবাড়ি ও অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা অলংকরিক ইট, টেরাকোটার টুকরো, বিষ্ণু ও মহাশ্রীধর মূর্তিসহ অসংখ্য প্রত্নবস্তু। কাঠের সোফা, খাট, হুক্কা, রামদা, বল্লম, বাঘের মাথা, মহিষের শিং, চরকা থেকে শুরু করে প্রাচীন সিন্দুক পর্যন্ত রয়েছে সংগ্রহে। আছে শহীদ শিল্পী আব্দুর রশিদের একটি ভাষ্কর্য—মা ও ছেলের মমতার দৃশ্য, যা ১৯৬০ সালের সৃষ্টি।
জাদুঘরের বাইরের দেয়ালে ময়মনসিংহ জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর ছবি ও সংক্ষিপ্ত বিবরণও প্রদর্শিত হচ্ছে, যা দর্শনার্থীদের স্থানীয় ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। এটি গ্রীষ্মকালে মঙ্গলবার থেকে শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে (দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত বিরতি)। শুক্রবার বিকেল ২টা থেকে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে, তবে রোববার বন্ধ এবং সোমবার অর্ধদিবস খোলা থাকে।
ঐতিহাসিক এই প্রাসাদ ও জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য অতীত ঐতিহ্য ও শিল্পসৌন্দর্যের এক চমৎকার মিলনস্থল। একদিনের জন্য হলেও ঘুরে এসে দেখা যেতে পারে সময়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা শশীলজ।