বৃহস্পতিবার, ১৫ই মে, ২০২৫| রাত ৪:২১

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক—একটি দীর্ঘ শীতল যুদ্ধের ইতিহাস ও বর্তমান উত্তেজনার চিত্র

প্রতিবেদক
staffreporter
মে ৫, ২০২৫ ৬:২৬ অপরাহ্ণ
পেহেলগাম হামলা

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক—একটি দীর্ঘ শীতল যুদ্ধের ইতিহাস ও বর্তমান উত্তেজনার চিত্র

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক হয়নি। রাজনৈতিক বিভাজন, সামরিক সংঘাত, কাশ্মীর ইস্যু, ধর্মীয়-জাতিগত বিভক্তি এবং সীমান্তজুড়ে চলমান সন্দেহ-অবিশ্বাস দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী উত্তেজনার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় এ সম্পর্ক কখনো উষ্ণ হয়েছে আবার হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটেছে, যার ফলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা বারবার হুমকির মুখে পড়েছে।

ঐতিহাসিক পটভূমি ও বড় বড় সংঘাত

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় কাশ্মীরকে ঘিরে প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ভারতের পক্ষে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পাকিস্তান তা মেনে নেয়নি। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়, কিন্তু কাশ্মীরের এক অংশ পাকিস্তানের (বর্তমান আজাদ কাশ্মীর) এবং এক অংশ ভারতের হাতে (জম্মু ও কাশ্মীর) রয়ে যায়। এই বিভাজনই ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মূলে রয়ে গেছে।

এরপর ১৯৬৫ সালে আবার কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধটি কিছুদিন স্থায়ী হলেও তা কোনো স্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারেনি।

১৯৭১ সালের যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর ফলেই জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা এবং ভারতের উদ্বাস্তু সমস্যার কারণে ভারত সামরিক হস্তক্ষেপ করে, এবং পাকিস্তানের সেনা আত্মসমর্পণ করে।

১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধ ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার পরে ঘটে, যা বিশ্বের নজর কাড়ে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর গোপনভাবে ভারতের কারগিল অঞ্চলে ঢুকে পড়া এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঘটনাটি দুই দেশের সম্পর্কে বড়সড় আঘাত হানে।

সন্ত্রাসবাদ ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন

২০০1 সালে ভারতের সংসদে হামলা, ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলা এবং সম্প্রতি ২০১৬ সালের উরি হামলা ও ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর সম্পর্ক আরও অবনতি ঘটে। ভারত প্রতিবারই অভিযোগ করেছে, পাকিস্তানের মাটি থেকে পরিচালিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর দায় রয়েছে এসব হামলার পেছনে। বিশেষ করে ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলায় পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বার জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক অনেকটাই কমিয়ে আনে।

২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ ও ‘বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক’ দুই দেশের মধ্যে প্রায় যুদ্ধের মত অবস্থা তৈরি করে। পাকিস্তান পাল্টা এয়ার অ্যাটাক চালায় এবং ভারতের এক পাইলটকে বন্দীও করেছিল, যাকে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

বর্তমান পরিস্থিতি ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা

বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হচ্ছে না। কূটনৈতিক সম্পর্ক সীমিত, বাণিজ্য বন্ধ, এবং সাধারণ মানুষদের যোগাযোগও প্রায় বন্ধ। ২০১৯ সালে ভারতের কাশ্মীর থেকে বিশেষ মর্যাদা (আর্টিকেল ৩৭০) বাতিল করাও দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় ধাক্কা। পাকিস্তান এটিকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুললেও সাড়া পায়নি।

তবে, আন্তর্জাতিক চাপ ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় পাকিস্তান কিছুটা নমনীয় হতে বাধ্য হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) সহায়তা পেতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তেজনা কমাতে হয়—এই চাপে পাকিস্তান ইদানীং ভারত সম্পর্কে বেশি উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে না।

অন্যদিকে, ভারত এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। চীন, আমেরিকা, রাশিয়া—সব দিকেই কূটনৈতিকভাবে সক্রিয়। পাকিস্তানকে আলাদা করে দেখার সময় ভারত এখন আর ব্যয় করে না।

তবে সীমান্তে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষ হয়, সেনা নিহত হয়, এবং যুদ্ধাবস্থার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়। শান্তি আলোচনা প্রায় নেই বললেই চলে। ক্রিকেট বা সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানও বন্ধ।

ভবিষ্যৎ কি আরও উত্তপ্ত না শীতল?

বিশ্লেষকরা মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, যতক্ষণ না কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে বাস্তবধর্মী আলোচনা হয়। আবার সন্ত্রাসবাদ ও রাজনৈতিক উগ্রতা দুই দেশেই শান্তির পথে বড় বাধা।

তবে এই শীতল যুদ্ধের আবহে জনসাধারণের মধ্যেও পরিবর্তন আসছে। দুই দেশের অনেক তরুণই চান শান্তি, চান পর্যটন, চান একে অপরের সংস্কৃতি জানতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভার্চুয়াল বন্ধুত্বও বাড়ছে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কৌশলগত ভারসাম্য ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপথের উপর।

মন্তব্য করুন
Spread the love

সর্বশেষ - সর্বশেষ