বৃহস্পতিবার, ২৪শে এপ্রিল, ২০২৫| রাত ৩:৪৮

মার্কিন বিচারক ট্রাম্পের ভয়েস অব আমেরিকা বন্ধের প্রচেষ্টা আটকে দিলেন

প্রতিবেদক
staffreporter
এপ্রিল ২৩, ২০২৫ ৮:৫৮ অপরাহ্ণ
মার্কিন বিচারক ট্রাম্পের ভয়েস অব আমেরিকা বন্ধের প্রচেষ্টা আটকে দিলেন

মার্কিন বিচারক ট্রাম্পের ভয়েস অব আমেরিকা বন্ধের প্রচেষ্টা আটকে দিলেন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভয়েস অব আমেরিকা (ভিওএ) বন্ধের উদ্যোগকে বেআইনি ঘোষণা করে তা আটকে দিয়েছেন এক মার্কিন ফেডারেল বিচারক। এই রায়ে বিচারক জানিয়েছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপ ছিল অবিবেচনাপ্রসূত এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই সিদ্ধান্ত ভয়েস অব আমেরিকার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত আরও দুটি সংবাদমাধ্যম—রেডিও ফ্রি এশিয়া এবং মিডল ইস্ট ব্রডকাস্টিং নেটওয়ার্কস—এর কার্যক্রম পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছে। তবে রেডিও ফ্রি ইউরোপ/রেডিও লিবার্টি এবং ওপেন টেকনোলজি ফান্ডের ক্ষেত্রে একই ধরনের আবেদন নাকচ করা হয়েছে।

ঘটনার পটভূমি
ভয়েস অব আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস-গঠিত এবং রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, গত ৮৩ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি প্রচারণার বিরুদ্ধে এবং স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন স্বার্থ তুলে ধরতে এই সংবাদমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে এর ইতিহাসের কারণে কেউ কেউ এটিকে রাষ্ট্রীয় প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে সমালোচনা করলেও, ভয়েস অব আমেরিকা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং তথ্যের নিরপেক্ষতা রক্ষার দাবি করে।

গত মার্চে ট্রাম্প প্রশাসন ভয়েস অব আমেরিকার ১,৩০০ জনের বেশি কর্মীকে প্রশাসনিক ছুটিতে পাঠায় এবং সংস্থাটির বাজেটে ব্যাপক কাটছাঁট করে। প্রশাসনের দাবি ছিল, এই সংবাদমাধ্যম “বামপন্থি পক্ষপাতিত্ব” প্রদর্শন করে এবং “আমেরিকানপন্থি” মনোভাবের অভাব রয়েছে। এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ভয়েস অব আমেরিকা আদালতে মামলা দায়ের করে, যেখানে তাদের আইনজীবীরা জানান, সংস্থাটি সত্যনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের প্রতিশ্রুতি পালন করে।

বিচারকের রায়
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্রের জেলা বিচারক রয়স ল্যাম্বার্থ তাঁর রায়ে ট্রাম্প প্রশাসনের ভয়েস অব আমেরিকা বন্ধের উদ্যোগকে বেআইনি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “এই সিদ্ধান্ত ছিল অবিবেচনাপ্রসূত এবং তড়িঘড়ি করে নেওয়া, যা প্রমাণ করে যে প্রশাসনের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে সংস্থাটির পুনর্গঠন করা।”

বিচারক ল্যাম্বার্থ নির্দেশ দেন যে, ট্রাম্প প্রশাসনকে ভয়েস অব আমেরিকার পূর্বের কার্যক্ষমতা পুনর্বহাল করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে বাজেট কাটছাঁট এবং কর্মী ছাঁটাইয়ের আগের অবস্থায় সংস্থাটিকে ফিরিয়ে আনা। একই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রেডিও ফ্রি এশিয়া এবং মিডল ইস্ট ব্রডকাস্টিং নেটওয়ার্কসের ক্ষেত্রেও, যারা রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত হয়। তবে রেডিও ফ্রি ইউরোপ/রেডিও লিবার্টি এবং ওপেন টেকনোলজি ফান্ডের ক্ষেত্রে অনুরূপ আবেদন নাকচ করা হয়েছে।

বিচারকের মতে, ট্রাম্প এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্ররা এই সংবাদমাধ্যমগুলোকে “বামপন্থি” বা “আমেরিকাবিরোধী” হিসেবে চিহ্নিত করে বাজেট কাটছাঁট এবং আদর্শিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়েছেন। এই পদক্ষেপ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতার নীতির পরিপন্থী বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।

রায়ের তাৎপর্য
এই রায়কে মিডিয়া কর্মীদের সংগঠন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করা গোষ্ঠীগুলো একটি “শক্তিশালী বার্তা” হিসেবে বিবেচনা করছে। তাদের মতে, এই রায় স্বাধীন সাংবাদিকতার গুরুত্ব এবং গণতন্ত্র রক্ষায় এর অপরিহার্য ভূমিকাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সিদ্ধান্ত ট্রাম্প প্রশাসনের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

মিডিয়া বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভয়েস অব আমেরিকার মতো সংস্থাগুলো বিশ্বব্যাপী মার্কিন মূল্যবোধ এবং গণতান্ত্রিক আদর্শ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংস্থাগুলো বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা কেবল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাই নয়, বৈশ্বিক মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

ভয়েস অব আমেরিকার ইতিহাস
ভয়েস অব আমেরিকা ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গঠিত হয়, প্রাথমিকভাবে নাৎসি প্রচারণার বিরুদ্ধে সত্য তথ্য প্রচারের জন্য। স্নায়ুযুদ্ধের সময় এটি মার্কিন স্বার্থ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রচারে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যদিও এই ইতিহাসের কারণে অনেকে ভয়েস অব আমেরিকাকে রাষ্ট্রীয় প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে সমালোচনা করেন, সংস্থাটি দাবি করে যে এটি বর্তমানে নিরপেক্ষ এবং বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মানদণ্ড মেনে চলে।

বর্তমানে ভয়েস অব আমেরিকা বিশ্বের ৪০টিরও বেশি ভাষায় সংবাদ পরিবেশন করে এবং প্রতি সপ্তাহে লাখ লাখ শ্রোতা-দর্শকের কাছে পৌঁছে। এটি বিশেষ করে সেইসব দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেখানে স্থানীয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত।

ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচনা
ট্রাম্প প্রশাসনের গণমাধ্যম নীতি এবং সংবাদমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা এর আগেও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ভয়েস অব আমেরিকার ক্ষেত্রে তাদের অভিযোগ ছিল, এই সংস্থা “বামপন্থি পক্ষপাতিত্ব” প্রদর্শন করে এবং মার্কিন স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হয়। তবে ভয়েস অব আমেরিকার কর্মকর্তারা এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তাদের সাংবাদিকতা সত্য এবং নিরপেক্ষতার উপর ভিত্তি করে।

বিচারক ল্যাম্বার্থের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপ ছিল রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত। এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ এবং সংবাদমাধ্যমকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
এই রায় যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মিডিয়া কর্মীদের সংগঠনগুলো এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে, এবং এটিকে গণতন্ত্রের জন্য একটি জয় হিসেবে দেখছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে, যা এই বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভয়েস অব আমেরিকার মতো সংস্থাগুলো বিশ্বব্যাপী তথ্য প্রবাহ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংস্থাগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা কেবল গণমাধ্যমের স্বাধীনতাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাবকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

উপসংহার
মার্কিন বিচারক রয়স ল্যাম্বার্থের এই রায় ভয়েস অব আমেরিকা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত সংবাদমাধ্যমের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিকে পুনরায় নিশ্চিত করেছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং এই রায়ের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে আলোচনা চলছে। ভয়েস অব আমেরিকার কর্মীরা এই রায়কে তাদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেখছেন এবং বিশ্বব্যাপী নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

মন্তব্য করুন
Spread the love

সর্বশেষ - বানিজ্য ও অর্থনীতি