ট্রাম্পের নতুন হুমকি: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মধ্যস্থতা থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা
তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে মস্কো এবং কিয়েভ যদি আন্তরিক প্রচেষ্টা না দেখায় এবং শিগগিরই এই সংঘাতের সমাধানে দৃশ্যমান অগ্রগতি না হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা থেকে সরে যাবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই কঠোর হুমকি দিয়েছেন, যা বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে।
গত শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প এই অবস্থান স্পষ্ট করেন। এর আগে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও প্যারিসে এক সম্মেলনে বলেছিলেন, “যদি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এই ইস্যুতে আর নিজেকে জড়াবে না।” রুবিওর এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সাংবাদিকরা ট্রাম্পের মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, “রুবিও ভুল বলেননি। যদি কোনো কারণে রাশিয়া বা ইউক্রেনের মধ্যে কেউ যুদ্ধবিরতির প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে, তাহলে আমরা তাদের বলব, ‘তোমরা নির্বোধ, বোকার দল, ভয়াবহ মানুষ।’ এরপর আমরা তাদের পাশ কেটে চলে যাব।”
তবে, ট্রাম্প আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “আমরা আশা করছি, এমন কিছু ঘটবে না। আমরা খুব শিগগিরই এই যুদ্ধ শেষ করতে পারব।”
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়, যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন। এই যুদ্ধের পেছনে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ নিয়ে বিরোধ, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদের আকাঙ্ক্ষা, এবং ২০১৫ সালের মিনস্ক চুক্তির শর্ত পূরণে ব্যর্থতাসহ একাধিক ইস্যু জড়িত। গত তিন বছরে এই যুদ্ধে প্রায় ১১,০০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, এবং উভয় পক্ষই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে।
ট্রাম্পের পূর্বের প্রতিশ্রুতি ও পদক্ষেপ
২০২২ সালে যুদ্ধ শুরুর সময় ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে পারতেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে গত ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর তিনি যুদ্ধবিরতিকে তাঁর প্রশাসনের অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেন।
ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্প এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা বন্ধ করেছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন, এবং গত মার্চে একটি লিখিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মস্কো ও কিয়েভে পাঠিয়েছেন। তবে, রাশিয়া এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রস্তাবে যুদ্ধের মূল কারণগুলোর সমাধানের বিষয়ে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
পূর্বের হুমকি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
এর আগেও ট্রাম্প এই যুদ্ধে মধ্যস্থতা থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। গত ১ মার্চ তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এমন ইঙ্গিত দেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সেই হুমকি ছিল ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে চাপ প্রয়োগের জন্য। তবে, এবারের হুমকি উভয় পক্ষের প্রতি সমানভাবে কঠোর, যা ট্রাম্পের ক্রমবর্ধমান হতাশার ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এই অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং তাঁর নিজস্ব প্রশাসনিক লক্ষ্যের সঙ্গেও সম্পর্কিত। ইউক্রেনে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক ও আর্থিক সহায়তার বিষয়ে মার্কিন কংগ্রেসে ক্রমবর্ধমান বিরোধিতার মুখে ট্রাম্প এই যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ট্রাম্পের এই হুমকি রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। রাশিয়া তাদের অবস্থানে অনড় থাকলেও, ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্র যদি মধ্যস্থতা বা সহায়তা থেকে সরে যায়, তাহলে ইউক্রেনের জন্য এই যুদ্ধ আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে, ট্রাম্পের এই অবস্থান ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর মতো অন্য মিত্রদের এই সংকটে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে উৎসাহিত করতে পারে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতি, জ্বালানি সরবরাহ এবং ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক হুমকি এই সংঘাতের সমাধানে নতুন অনিশ্চয়তা যোগ করলেও, বিশ্ব সম্প্রদায় এখনও শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজছে।
সূত্র: এএফপি, এনডিটিভি অনলাইন