তালেবানের ‘সন্ত্রাসী সংগঠনের’ তকমা বাতিল করল রাশিয়া
আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান গোষ্ঠীর ওপর থেকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ তকমা বাতিল করেছে রাশিয়ার সুপ্রিম কোর্ট। তালেবানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) রুশ সুপ্রিম কোর্ট এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্ত তালেবানের সঙ্গে রাশিয়ার কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
তালেবানের ক্ষমতায় আসা ও রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি
২০২১ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক বাহিনী আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার হওয়ার পর তালেবান দেশটির ক্ষমতা দখল করে। মস্কো এই প্রত্যাহারকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনা করে এবং তখন থেকে তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। রাশিয়া তালেবানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়
রাশিয়ার সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ওলেগ নেফেদভ রায়ে বলেন, “রুশ ফেডারেল তালিকায় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে তালেবানের কার্যক্রমের ওপর পূর্বে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করা হলো।” তিনি জানান, এই সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে আইনি কাঠামোতে কার্যকর হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা তাস জানায়, গত মাসে রাশিয়ার প্রসিকিউটর জেনারেল তালেবানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মস্কো সফরের পর এই তকমা বাতিলের জন্য সুপ্রিম কোর্টে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
তালেবানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক
তালেবানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। ২০২২ এবং ২০২৪ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে রাশিয়ার আয়োজিত ইকোনমিক ফোরামে তালেবানের প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। এছাড়া, ২০২৪ সালের অক্টোবরে মস্কোতে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে তালেবানের একজন শীর্ষ কূটনীতিক সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাতগুলো তালেবানের সঙ্গে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার ইঙ্গিত দেয়।
রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি তালেবানের প্রতি গত দুই দশকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৯৪ সালে আফগান গৃহযুদ্ধের সময় তালেবান গঠিত হয়, যার মূল নেতৃত্বে ছিলেন ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা মুজাহিদিন যোদ্ধারা। সেই সময় তালেবানকে রাশিয়া একটি হুমকি হিসেবে দেখলেও বর্তমানে তাদের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে ঝুঁকেছে।
সিদ্ধান্তের তাৎপর্য
তালেবানের ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ তকমা বাতিল হলেও এই সিদ্ধান্ত তাদের আন্তর্জাতিকভাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সমতুল্য নয়। তবে, এটি রাশিয়ার কর্মকর্তাদের জন্য তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আইনি ও কূটনৈতিক জটিলতা কমাবে। এই পদক্ষেপ তালেবানের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানোর পথ সুগম করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মস্কো তালেবানকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে দেখছে। আফগানিস্তানে আইএসআইএস-এর মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান রোধে তালেবানের ভূমিকাকে রাশিয়া ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করছে। এছাড়া, আফগানিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং এর প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভাবনা রাশিয়ার অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
তালেবানের ক্ষমতায় আসার পর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিভক্ত। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো তালেবানের শাসনের সমালোচনা করে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখেছে। বিশেষ করে, তালেবানের নারী শিক্ষা ও অধিকারের ওপর বিধিনিষেধের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে অনীহা প্রকাশ করেছে।
অন্যদিকে, রাশিয়া, চীন এবং ইরানের মতো দেশগুলো তালেবানের সঙ্গে বাস্তববাদী সম্পর্ক গড়ে তুলছে। রাশিয়ার এই সিদ্ধান্ত তালেবানের প্রতি তাদের নরম দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন এবং আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের কৌশলগত পদক্ষেপ।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশ্লেষকদের মতে, তালেবানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক জোরদার হলে এটি আফগানিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। রাশিয়ার এই পদক্ষেপ অন্য দেশগুলোকে তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার জন্য প্রভাবিত করতে পারে। তবে, তালেবানের অভ্যন্তরীণ নীতি, বিশেষ করে মানবাধিকার ও শাসনব্যবস্থার বিষয়গুলো, তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথে প্রধান বাধা হিসেবে রয়ে গেছে।
রাশিয়ার সুপ্রিম কোর্টের এই রায় তালেবানের সঙ্গে সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলেও, এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। এই সিদ্ধান্তের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এখনও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
সূত্র: এএফপি