গাজা পুনর্গঠনের মিসরীয় পরিকল্পনায় বাদ পড়ছে হামাস
গাজা উপত্যকার ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই নতুন পরিকল্পনার পথে এগোচ্ছে মিসর, তবে এতে থাকছে না ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় গাজা পুনর্গঠনের জন্য মিসর একটি বিকল্প পরিকল্পনা তৈরি করছে, যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা’ প্রকল্পের বিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। এই পরিকল্পনায় হামাসকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে রাখা হবে। তবে ইসরায়েল, হামাস এবং বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে এখনও রয়েছে অনিশ্চয়তা, যা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে।
মিসরের পরিকল্পনা অনুসারে, গাজার পুনর্গঠন প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য একটি অস্থায়ী সামাজিক বা সম্প্রদায়ভিত্তিক সমর্থন কমিটি গঠন করা হবে, যেখানে হামাসের কোনো সদস্য থাকবে না। এতে মূলত নিরপেক্ষ টেকনোক্র্যাট, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যাতে কোনও নির্দিষ্ট গোষ্ঠী এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে। তবে হামাসের ভবিষ্যৎ সামরিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত না থাকায় এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
গাজার পুনর্গঠনে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশও অর্থায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার পুনর্গঠনের জন্য তহবিল গঠনের পরিকল্পনা করছে, তবে তাদের স্পষ্ট শর্ত রয়েছে—গাজার বাসিন্দাদের জোরপূর্বক মিসর বা জর্ডানে সরিয়ে দেওয়া যাবে না এবং পুনর্গঠনের কাজ করতে হবে স্থানীয় বাসিন্দাদের অধিকার নিশ্চিত করেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েলের সামরিক হামলায় গাজার প্রায় ৬৫ শতাংশ অবকাঠামো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে, ফলে পুনর্গঠনের এই প্রক্রিয়া তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় নিতে পারে।
গাজায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখনও অনিশ্চিত থাকায় ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এই পরিকল্পনার বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। ইউরোপীয় কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ইসরায়েল যদি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের জন্য একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা না দেয়, তাহলে কোনও আরব দেশ গাজায় স্থায়ীভাবে নিরাপত্তা বাহিনী পাঠাতে রাজি হবে না। ফলে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হতে পারে।
আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে একটি গুরুত্বপূর্ণ আরব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে গাজার পুনর্গঠনের জন্য ট্রাম্প পরিকল্পনার বিকল্প নিয়ে আলোচনা হবে এবং এর কিছু অংশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। এখন পর্যন্ত সৌদি আরব হামাসকে সরাসরি প্রশাসন থেকে বাদ দেওয়ার আহ্বান জানায়নি, তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শীর্ষ কূটনৈতিক উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ আরব লীগের মহাসচিব আহমেদ আবুল ঘেইতের সাম্প্রতিক মন্তব্যের প্রশংসা করেছেন, যেখানে তিনি গাজার প্রশাসন থেকে হামাসকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আবুল ঘেইত সতর্ক করে বলেছেন, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার হুমকি এবং এর ফলে উপত্যকার সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ার ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে ফিলিস্তিনি জনগণের স্বার্থকে অবশ্যই রাজনৈতিক স্বার্থের চেয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প পরিকল্পনা অনুযায়ী যদি ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে গাজা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে এটি গোটা অঞ্চলে নতুন সংকট তৈরি করবে এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে, যা আরব বিশ্ব কখনোই মেনে নেবে না।
এদিকে পশ্চিম তীরের শাসক ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) মিসরের এই নতুন পরিকল্পনাকে সমর্থন করেনি। তাদের আশঙ্কা, এই উদ্যোগ গাজা ও পশ্চিম তীরের মধ্যে স্থায়ী বিভাজন তৈরি করতে পারে, যা দুটি পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। ফলে ফিলিস্তিনি স্বশাসন কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও অবশ্য এই পরিকল্পনাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেননি। তবে তিনি সতর্ক করেছেন যে, যদি হামাস গাজায় থাকে, তাহলে এটি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ ইসরায়েল কখনোই হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজাকে মেনে নেবে না এবং এই বিরোধ চক্রাকার সংকটে পরিণত হবে। এমন পরিস্থিতিতে গাজার ভবিষ্যৎ পুনর্গঠনের চূড়ান্ত রূপরেখা কী হবে, তা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।