ভ্যাট বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা সাধারণ মানুষ
বছরের শুরুতেই একদিকে বাড়তি বাড়ি ভাড়া, অন্যদিকে সন্তানদের স্কুলে ভর্তি নিয়ে অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়েন সাধারণ মানুষ। এরই মধ্যে সরকারের নতুন কর নীতির ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। চলতি বছরের শুরুতে ভ্যাট ও ট্যাক্স বাড়িয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের উদ্যোগ নেয় সরকার। উপদেষ্টারা তখন বলেছিলেন, এতে মানুষের ওপর তেমন চাপ পড়বে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও স্বীকার করেছেন, ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি কখনও দুই অঙ্কের ঘরও ছাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেও ওষুধ, এলপি গ্যাস, মোবাইল সিমসহ ৬৭টি পণ্য ও সেবায় শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে, ফলে ভোক্তারা আরও সংকটে পড়ছেন।
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে বসবাসকারী বেকারি কর্মী কামরুজ্জামান জানান, দুই সন্তানের নতুন ক্লাসে ভর্তির জন্য ৭ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে, বাড়ি ভাড়াও বেড়েছে ৬০০ টাকা। এর মধ্যে ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়ে গেছে, অথচ তার আয় এক টাকাও বাড়েনি। সরকারি চাকরিজীবী গোলাম রসুলও জানান, নতুন বছরের শুরুতে সন্তানদের স্কুল-কলেজে ভর্তি ও বাড়তি ভ্যাটের কারণে তার সংসার খরচ বেড়েছে, যা সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে আমদানি করা ফল, পোশাক, বিস্কুট, জুস, টিস্যুর দাম বেড়েছে। চাল-ডালের দাম আগে থেকেই নাগালের বাইরে ছিল। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর চাপ আরও বেড়েছে। ফলে অনেকেই সরকারের কাছে করের আওতা বাড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছেন, যেন ভ্যাট না বাড়িয়েও রাজস্ব আদায় সম্ভব হয়।
শিক্ষা ব্যয়ও বেড়েছে। নতুন বছরে স্কুলের ভর্তি ফি ও বেতন বাড়ানো হয়েছে, ফলে অনেক অভিভাবক বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন। জানুয়ারি মাসে শিক্ষা উপকরণের দাম ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গাইড বইয়ের দামও দ্বিগুণ হয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছেন, ফলে পুষ্টির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির এই পরিস্থিতিতে ভ্যাট বাড়ানো যুক্তিযুক্ত হয়নি। বাজেট ঘোষণার সময় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত। ধনীদের ওপর কর বাড়িয়ে রাজস্ব সংগ্রহের পরামর্শও দিচ্ছেন তারা।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ স্বীকার করেছেন, ব্যবসায়ীরা ভ্যাট বৃদ্ধির চেয়েও বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছেন, ফলে ভোক্তারা অতিরিক্ত চাপের শিকার হচ্ছেন। তবে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, আগামী বাজেটে ভ্যাট নীতির সংশোধন করা হবে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার ভ্যাট রেট একীভূতকরণের নীতিতে যাচ্ছে, ফলে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসানো হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখন উপযুক্ত ছিল না।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে এবং মধ্যবিত্তদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সরকার বলছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। তবে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, পরবর্তী বাজেটে এমন নীতির পুনর্বিবেচনা করা হবে, যাতে অর্থনৈতিক চাপ কিছুটা লাঘব হয়।