৬২০ বন্দি ফেরত দিলো ইসরায়েল, হামাসের চার মৃতদেহ হস্তান্তর
গাজার রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্যে অবশেষে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে এসেছে বন্দি বিনিময়ের চুক্তির নতুন কার্যক্রম। দীর্ঘদিনের অচলাবস্থার পর ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীদের প্রচেষ্টায় আবারও সমঝোতা হয়েছে। এর ফলে ৬২০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরায়েল, আর বিনিময়ে হামাস রেড ক্রসের মাধ্যমে চার ইসরায়েলি জিম্মির মরদেহ হস্তান্তর করেছে। ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী কোনো ধরনের অনুষ্ঠান ছাড়াই এই বিনিময় হলো।
এই বিনিময় নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই উত্তেজনা চলছিল, কারণ ইসরায়েল বন্দি মুক্তি স্থগিত করেছিল এবং হামাস এটিকে চুক্তির গুরুতর লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছিল।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েল অভিযোগ তোলে যে হামাস তাদের হাতে থাকা ইসরায়েলি বন্দিদের প্রতি ‘নিষ্ঠুর আচরণ’ করেছে, তাই ৬২০ ফিলিস্তিনির মুক্তি আটকে রাখা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় হামাস জানায়, ইসরায়েল এভাবে চুক্তি ভঙ্গ করছে, যা পুরো যুদ্ধবিরতি আলোচনাকে বাধাগ্রস্ত করবে। পরিস্থিতি যখন আরও জটিল হয়ে উঠছিল, তখনই মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর হস্তক্ষেপে দুই পক্ষ একটি চুক্তিতে পৌঁছায়। বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, এই অচলাবস্থা কাটিয়ে ফেলা হয়েছে এবং বন্দি বিনিময়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) ভোরে ইসরায়েল পশ্চিম তীরের ওফার কারাগার থেকে ৬২০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেয়। তাদের অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে অপেক্ষমাণ স্বজনরা আবেগাপ্লুতভাবে তাদের স্বাগত জানান। অনেক পরিবারের দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান হলো, কিন্তু এই বিনিময় নিয়ে এখনও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে, কারণ ইসরায়েলি হামলায় এখনো বহু ফিলিস্তিনি বন্দি রয়েছে এবং গাজায় অব্যাহত ধ্বংসযজ্ঞে বহু নিরপরাধ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে।
অন্যদিকে, হামাস চার ইসরায়েলি জিম্মির মরদেহ রেড ক্রসের মাধ্যমে ইসরায়েলের কাছে হস্তান্তর করে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কার্যালয় নিশ্চিত করেছে যে তারা মরদেহগুলো পেয়েছে এবং তাদের শনাক্তের জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। এই বিনিময়ের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর পরবর্তী কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পথ প্রশস্ত হয়েছে।
এদিকে, গাজায় মানবিক পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েলের লাগাতার হামলায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে, এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে হাসপাতালগুলোর দুর্দশার মধ্যে। গত দুই সপ্তাহে তীব্র শীতের কারণে গাজার এক হাসপাতালের নবজাতক ওয়ার্ডে ছয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে। পর্যাপ্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকায় এই শীতজনিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বারবার আহ্বান জানাচ্ছেন যে, ইসরায়েলি হামলায় গৃহহীন হওয়া লক্ষাধিক মানুষের জন্য জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র ও পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা হোক। শরণার্থী শিবিরগুলোতে চিকিৎসা সেবা এবং মানবিক সহায়তার সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
অন্যদিকে পশ্চিম তীরের নূর শামস শরণার্থী শিবির থেকে সবাইকে সরে যেতে নির্দেশ দিয়েছে ইসরাইল। নেতানিয়াহু বাহিনীর এমন ঘোষণার পর আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়তে শুরু করেছেন সেখানকার বাসিন্দারা। তারা জানান, শরণার্থী শিবিরের বেশকিছু স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে রাস্তা বানানোর পরিকল্পনা আছে ইসরাইল।
গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের সময়সীমা শেষ হতে চলেছে ১ মার্চ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে কি দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথ সুগম হবে, নাকি এটি শুধু স্বল্পমেয়াদী সমঝোতা? ইসরায়েলি বাহিনী এখনও গাজার বিভিন্ন অংশে হামলা চালাচ্ছে, আর হামাসও ইসরায়েলের নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারী দেশ গাজায় ত্রাণ পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই বন্দি বিনিময় আপাতদৃষ্টিতে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও, গাজার হাজারো বাস্তুচ্যুত মানুষের কষ্টের আসল সমাধান এখনো অধরাই রয়ে গেছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও গাজার মানুষদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হওয়ার পথে কতটা অগ্রগতি হবে, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।