সুন্দরবনের গহীনে বেঁচে থাকা মোহনীয় ডলফিন: একটি বিলুপ্তপ্রায় জীবনের গল্প
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন শুধু রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য বিখ্যাত নয়; এটি আরও একটি বিশেষ প্রাণীর আশ্রয়স্থল, যা ক্রমেই বিলুপ্তির পথে—ইরাবতী ডলফিন। এই ডলফিন, যা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নদী ও উপকূলীয় জলে দেখা যায়, বর্তমানে প্রকৃতি ও পরিবেশের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সুন্দরবনের নদীগুলোতে এখনও এদের দেখা মেলে, তবে প্রতিকূল পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানবসৃষ্ট দূষণের কারণে এই অনন্য প্রাণীটির জীবন হুমকির মুখে।
ইরাবতী ডলফিন দেখতে সামুদ্রিক ডলফিনের মতো হলেও এর আচরণ এবং বাসস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটি সাধারণত নদী এবং ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে বাস করে। সুন্দরবনের পশুর, শিবসা, বলেশ্বর, এবং জুড়ানী নদীতে এদের বিচরণ দেখা যায়। এরা দলবদ্ধভাবে চলাচল করে এবং শ্বাস নেওয়ার জন্য বারবার পানির ওপরে ভেসে ওঠে। স্থানীয় জেলেদের কাছে এটি "শিশু মাছ" নামে পরিচিত, কারণ এদের স্পর্শকাতর ও স্নিগ্ধ স্বভাব।
তবে, এই ডলফিনের জীবন আজ বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। নদীতে অবৈধ জাল বসানো, তেল দূষণ এবং জাহাজ চলাচলের ফলে এদের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে, মাছ ধরার অবৈধ পদ্ধতি এবং বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার এই ডলফিনের প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুন্দরবনের জলবায়ু পরিবর্তন এবং লবণাক্ততার বৃদ্ধি এদের বাসস্থান ধ্বংস করছে, ফলে এই প্রাণীগুলোর সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে।
সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, সুন্দরবনে ইরাবতী ডলফিনের সংখ্যা ২০০টির নিচে নেমে এসেছে। তবে এদের রক্ষায় কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বন বিভাগ এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংগঠনগুলো এই ডলফিনের আবাসস্থল সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে। স্থানীয় জেলেদের সচেতন করার জন্য বিভিন্ন কর্মশালা এবং প্রচারণা চালানো হচ্ছে, যাতে তারা ডলফিনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন এবং অবৈধ কার্যকলাপ বন্ধ করেন।
সুন্দরবনের ইরাবতী ডলফিন কেবল একটি প্রাণী নয়; এটি সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি আমাদের পরিবেশের প্রতি একটি সতর্কবার্তা যে, যদি আমরা এখনই উদ্যোগ না নিই, তবে ভবিষ্যতে আমাদের পরিবেশ থেকে এই অপরূপ জীবটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
ডলফিনের অস্তিত্ব রক্ষা শুধু একটি প্রাণী সংরক্ষণ নয়, বরং এটি আমাদের নিজস্ব জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি। সুন্দরবনের গভীরে এখনো যে ইরাবতী ডলফিন বেঁচে আছে, তা আমাদের দায়িত্বের প্রতি এক মৃদু তাগিদ দেয়, যা আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।