শান্তি আলোচনা নাকি রাজনৈতিক চাপ? সৌদিতে জেলেনস্কি-রুবিও বৈঠকে উত্তেজনার ইঙ্গিত
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে নতুন কূটনৈতিক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সৌদি আরবের জেদ্দায় পৌঁছেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। এই বৈঠক শান্তি আলোচনার মোড় নিতে চলেছে, নাকি রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার নতুন কৌশল— সেটি নিয়ে বিতর্ক চলছে বিশ্বমহলে।
স্থানীয় সময় সোমবার সৌদি আরবে পৌঁছান জেলেনস্কি। কিছুক্ষণ পরেই সেখানে পৌঁছান মার্কো রুবিও। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মধ্যস্থতায় আয়োজিত এই বৈঠকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি শুধু একটি শান্তি আলোচনা নয়; বরং এটি ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নিজেদের কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী করার একটি কূটনৈতিক প্রচেষ্টা।
জেলেনস্কি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তির জন্য শক্তিশালী কূটনীতি এবং সামরিক অবস্থান একসঙ্গে কার্যকর হতে হবে। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও ইউরোপীয় ঐক্যের মাধ্যমে ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তবে তিনি এটাও স্পষ্ট করেছেন যে, কিয়েভ কোনও একতরফা শর্তে যুদ্ধবিরতিতে রাজি নয়।
এই বৈঠকের ঠিক আগেই কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনীয় সেনাদের বিরুদ্ধে নতুন অভিযানে নামে রুশ বাহিনী। একটি গ্যাস পাইপলাইনের ভেতর লুকিয়ে থেকে হামলার পরিকল্পনা করেছিল রুশ সেনারা, তবে ইউক্রেনীয় বাহিনী তাদের শনাক্ত করে পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রেও উত্তেজনা বেড়েছে বৈঠকের প্রাক্কালে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, হাজার হাজার তরুণ সেনা ও বেসামরিক নাগরিকের জীবন বাঁচাতে তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধ করতে চান। তবে তার প্রশাসনের সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপ ইঙ্গিত দিচ্ছে, তারা হয়তো ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে দ্রুত কোনো সমাধানে পৌঁছানোর জন্য। কিছুদিন আগেই ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনের সঙ্গে সামরিক গোয়েন্দা তথ্য ও স্যাটেলাইট ডেটা ভাগাভাগি বন্ধ করে দিয়েছে, যা মূলত কিয়েভকে আলোচনায় বাধ্য করার কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি সিহিবা জানিয়েছেন, তিনি যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপে বলেছেন, ইউক্রেনের চেয়ে আর কেউ যুদ্ধের অবসান চাইছে না। তবে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে যদি কোনো আপস চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেটি কিয়েভ মেনে নেবে না।
রাজনৈতিক মহলে জোর আলোচনা চলছে যে, জেলেনস্কি এবং ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে সাম্প্রতিক দূরত্বের কারণ আসলে একটি অসম চুক্তি। মার্কিন প্রশাসন ইউক্রেনের ওপর একটি খনিজ চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য চাপ দিচ্ছিল, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগের শর্ত থাকলেও কিয়েভের জন্য নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন জেলেনস্কি, যার ফলে হোয়াইট হাউসের অসন্তোষ বাড়তে থাকে।
এদিকে, ইউরোপীয় দেশগুলো ইতোমধ্যে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করার ঘোষণা দিয়েছে। নতুন সামরিক সহায়তা প্যাকেজ, উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে তারা। তবে ওয়াশিংটন ইউক্রেনের ন্যাটো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না, যা কিয়েভের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সৌদি আরবে আয়োজিত এই বৈঠক শুধু ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্যই নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একটি শক্তিশালী মোড় নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিই ইউক্রেনের পাশে থাকবে, নাকি তারা রাজনৈতিক কৌশল পাল্টে কিয়েভকে নতুন শর্তের দিকে ঠেলে দেবে— সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।