এ বছর দেশে রেকর্ড পরিমাণ বোরো ধান উৎপাদন হলেও কৃষক এবং ভোক্তা কেউই এর সুফল পাচ্ছেন না। বোরো মৌসুমের এই ভরা সময়েও চালের দাম বাড়ছে। সরকারের নজরদারির অভাবে মোকামে মিলাররা চালের দাম বাড়িয়ে বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। ফলশ্রুতিতে আড়ত থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত চালের দাম বেড়ে গেছে। যদিও চাল আমদানি ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ভালো হলেও দাম কমানো যাচ্ছে না। সরকারের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এখনও ব্যর্থ।
কৃষকের হাতে ধান থাকাকালীন ধানের দাম কম থাকে, তবে ব্যবসায়ীদের হাতে গেলে চালের দাম বেড়ে যায়। মিলাররা ধানের দাম কমিয়ে রেখে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, যা কৃষক ও ভোক্তাদের জন্য ক্ষতিকর। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে চালের দাম গড়ে ১৫ শতাংশ বেড়েছে, যার মধ্যে চিকন চালের দাম এক মাসে ৫ শতাংশ এবং মাঝারি ও মোটা চালের দাম ৯ শতাংশ বাড়েছে। অভিযোগ আছে, চালের মোকামে মিলাররা বাজার অস্থির করছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশের মোট চালের ৫৫ শতাংশ বোরো মৌসুমে উৎপাদিত হয়। এ বছর বোরোর উৎপাদন রেকর্ড ২ কোটি ১৪ লাখ টনে পৌঁছেছে। এর আগের অর্থবছরগুলোর তুলনায় বাড়তি উৎপাদন সত্ত্বেও বাজারে দাম কমেনি।
টিসিবির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নাজিরশাইল ও মিনিকেট চালের দাম ৫.২৬ শতাংশ, পাইজাম ও লতার দাম ৮.৭০ শতাংশ এবং ইরি ও স্বর্ণার দাম ৯.৫২ শতাংশ বেড়েছে। খাদ্যমন্ত্রণালয় বলছে, বাজারে দাম বাড়ার জন্য কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই এবং সরকারের গুদামে পর্যাপ্ত চাল মজুত রয়েছে।
বাদামতলী ও বাবুবাজার চাল আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন, দেশের ধান-চালের বাজার এখন অটো রাইচ মিল ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে। তারা প্রতিযোগিতায় ধান কিনছে, যার ফলে ধানের দাম বেড়েছে এবং বর্তমান আবহাওয়াও চাল উৎপাদনের জন্য অনুকূল নয়, যা দাম বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলেছে।
কৃষকরা বলছেন, যেহেতু ধান কেনাকাটায় প্রতিযোগিতা হলে তাদের লাভ হওয়া উচিত, কিন্তু এ বছর তারা বড় মুনাফা পাননি। অনেক কৃষক মনে করছেন, চালের বাজারে দাম বাড়ার ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
রাজধানীর খুচরা বাজারে ঈদের পর চালের দাম বেড়েছে। এখন মোটা চালের দাম ৫৮ থেকে ৬৫ টাকা, সরু চালের মধ্যে জিরাশাইল ৭৪ থেকে ৮০ টাকা, মিনিকেট ৭৬ থেকে ৮৪ টাকা, এবং কাটারিভোগ ৭০ থেকে ৭৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
চালের বাজার অস্থিরতার জন্য ব্যবসায়ীরা ‘সিন্ডিকেট’ ও ‘করপোরেট দখল’ এর অভিযোগ তুলছেন। জয়পুরহাটের চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী জানিয়েছেন, বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান বাজার থেকে হাজার হাজার মণ ধান কিনেছে, যার কারণে ধানের দাম বেশি এবং ফলে চালের দাম বাড়ছে। সাধারণ মিলাররা প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে চাল ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, সরকারি ও বেসরকারিভাবে চাল আমদানির মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল হবে।
নাটোরের কৃষক তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু ফল দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। তিনি মনে করেন, ধানের দাম বেশি থাকলে চালের দাম বাড়তে বাধ্য।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবিরের মতে, বাজারে কারসাজির মাধ্যমে মিলাররা চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে, যা কৃষক ও ভোক্তাদের জন্য ক্ষতিকর। সরকার এ বিষয়ে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।
কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, বাজারে দাম বাড়লেও সরকার চেষ্টা করছে নিয়ন্ত্রণের। কৃষকদের ফসল মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে রক্ষায় সরকার কেনার সময় এগিয়ে এনেছে। তবে দুর্নীতি রোধ করতে না পারায় সমস্যা চলছেই।
বর্তমানে রাজধানীর খুচরা বাজারে মোটা চাল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৬০ থেকে ৬৭ টাকা, সরু চাল ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, যা সাম্প্রতিক সপ্তাহে ৩ থেকে ৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সারসংক্ষেপে, দেশি চালের দাম বাড়ার পেছনে বাজারে কারসাজি, দুর্নীতি ও করপোরেট নিয়ন্ত্রণ প্রধান কারণ, যা ভোক্তা ও কৃষক উভয়ের জন্যই উদ্বেগের বিষয়।