রমজানে গাজায় সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে ইসরায়েলের সম্মতি, তবে স্থায়ী চুক্তিতে অনিশ্চয়তা
ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতির মেয়াদ সাময়িকভাবে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পবিত্র রমজান ও ইহুদিদের ধর্মীয় উৎসব পাসওভারকে সামনে রেখে এই সাময়িক যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে নেতানিয়াহুর সরকার। তবে দীর্ঘমেয়াদি শান্তিচুক্তি বা যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে এখনো রয়েছে অনিশ্চয়তা। হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা কোনো সাময়িক যুদ্ধবিরতির অংশ হতে চায় না; বরং তারা একটি স্থায়ী বন্দিবিনিময় ও যুদ্ধবিরতি চুক্তি চায়।
গাজাসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে গত শনিবার থেকে শুরু হয়েছে মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাস। অন্যদিকে, ইহুদিদের পাসওভার উৎসব শুরু হবে আগামী ১২ এপ্রিল, যা চলবে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত। এই দুই ধর্মীয় উৎসবের সময় যুদ্ধ বন্ধ রাখার বিষয়ে আলোচনা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফের উদ্যোগে ইসরায়েল সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি দেয়।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানায়, মার্কিন প্রস্তাবের অধীনে গাজায় হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের মধ্যে প্রথম দফায় অর্ধেককে মুক্তি দেওয়া হবে। এই জিম্মিদের মধ্যে জীবিত ও মৃত উভয়েই থাকবেন। তবে স্থায়ী চুক্তি হলে বাকি জিম্মিরাও মুক্তি পাবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে, গত ১৯ জানুয়ারি ফিলিস্তিনের গাজায় প্রথম ধাপের ৪২ দিনের যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছিল। সেই চুক্তির আওতায় হামাস ২৫ জন জীবিত ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেয় এবং ৮ জন ইসরায়েলির মরদেহ হস্তান্তর করে। এর বিনিময়ে ইসরায়েল প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেয়।
প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি গতকাল মধ্যরাতে শেষ হয়েছে। এরপরই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় সাময়িক যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। তবে এটি দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতির অংশ কি না, সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি।
আলোচনার শর্ত অনুযায়ী, প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতির ১৬তম দিন থেকেই দ্বিতীয় ধাপের চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু ইসরায়েল যথাসময়ে আলোচনায় অংশ নেয়নি। কয়েক সপ্তাহ বিলম্বের পর, অবশেষে গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েল মিসরের কায়রোতে তাদের প্রতিনিধিদল পাঠায়। তবে ইসরায়েল মূলত দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহী নয়, বরং প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে হামাস প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। তাদের দাবি, যুদ্ধবিরতি ও বন্দিবিনিময়ের মূল চুক্তি অনুযায়ী দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা দ্রুত শুরু করতে হবে। হামাসের এক মুখপাত্র জানান, “আমরা কোনো সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহী নই। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি স্থায়ী চুক্তি, যা ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে।”
গত শুক্রবার রাতেই হামাস স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তারা দ্বিতীয় ধাপের চুক্তি বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা ছাড়া প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্তে সম্মত হবে না। এ অবস্থায় ইসরায়েলের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা আসলেও হামাস এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
অপরদিকে যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে ইসরায়েলের মধ্যেই দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। ইসরায়েলি কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি, হামাসের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায় না গিয়ে সামরিক অভিযান আরও তীব্র করা উচিত। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপে ইসরায়েল সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে বাধ্য হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য কঠিন এক সমীকরণ তৈরি হয়েছে। একদিকে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছেন, অন্যদিকে, নিজের সরকারের স্থায়িত্ব রক্ষা করতেই হচ্ছে। ইসরায়েলের সামরিক ও কট্টর ডানপন্থী নেতারা চুক্তির বিরোধিতা করলেও মার্কিন সমর্থন ধরে রাখতে নেতানিয়াহু আপাতত যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
মার্কিন প্রশাসন যুদ্ধবিরতি চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর ব্যাপারে আশাবাদী হলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু সময়ক্ষেপণের একটি কৌশল হতে পারে। সাময়িক যুদ্ধবিরতি ফিলিস্তিনের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা কিছুটা কমালেও স্থায়ী শান্তির পথ এখনো বহু দূরে।
ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে মনে করছেন, এটি যুদ্ধ শেষ করার কৌশল হতে পারে, আবার কেউ কেউ মনে করছেন, এটি শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক চাপ এড়ানোর একটি সাময়িক পদক্ষেপ।
বিশ্ব নেতারা এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন, তবে তারা স্থায়ী শান্তিচুক্তির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “যুদ্ধবিরতি অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি হতে হবে। এই অঞ্চলে শান্তি ফেরানোর জন্য আমাদের আরও বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেন, “গাজায় মানবিক বিপর্যয় অব্যাহত রয়েছে। শুধুমাত্র সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে কোনো সমাধান হবে না, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী শান্তির পথ তৈরি করতে হবে।”
বিশ্ব রাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের এই সংকট গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে ইসরায়েলের সম্মতি দিলেও এটি কতদিন স্থায়ী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যুদ্ধবিরতির নামে শুধু সময়ক্ষেপণ হলে, ভবিষ্যতে গাজায় সংঘাত আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্থায়ী সমাধান না হলে, এই সাময়িক যুদ্ধবিরতি আরেকটি নতুন সংঘর্ষের সূচনা মাত্র বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।