রাজধানীর গুলশান মডেল টাউনের ৩৫ নম্বর সড়কের একটি প্লট নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্লটটির মালিক জহিরা ওসমান শেখ। আশির দশকে সরকার প্লটটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। পরে রাজউক থেকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ নেওয়া প্লটটি ফেরত পেতে দুই দশক ধরে আদালতে মামলা লড়েন জহিরা। আদালত তাঁর পক্ষেই রায় দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ১৪ বছরেও আদালতের আদেশ কার্যকর হয়নি।
মালিকপক্ষের অভিযোগ, রায় বাস্তবায়নে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করা হয়েছিল। ঘুষ না দেওয়ায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয় উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। বর্তমানে রাজউক সেখানে আবাসন সংকট নিরসনে ‘রূপসা অ্যাপার্টমেন্ট’ নামে ১৫তলা ভবন নির্মাণ করছে। এই ভবনেই সরকারি কোটায় প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি এবং আওয়ামী লীগ মন্ত্রীদের স্বজনদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।এ অ্যাপার্টমেন্টেই সরকারি কোটায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, তৎকালীন বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, কামরুল হাসান মোল্লা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সচিব আমিনুল ইসলাম খানকে ৩ হাজার বর্গফুটের একটি করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়। সরকারি কোটায় এখানে আরেকটি ফ্ল্যাট রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিঞা নিজেই বরাদ্দ নেন।
জহিরা ওসমান শেখের স্বামী মো. ওসমান শেখ ১৯৬৩ সালে রাজউক থেকে প্লটটি লিজ নেন। পরে তিনি সম্পত্তিটি তাঁর স্ত্রী জহিরা ওসমান শেখকে দান করেন। জহিরা ওসমান এখন অসুস্থ। জীবনের শেষ সময়ে নিজের সম্পত্তি ফিরে পেতে তিনি আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন।
জহিরা ওসমান শেখের পক্ষে সব কাজ করছেন এম এ মোতালেব। তিনি জানান, জহিরার স্বামী প্লটটি বরাদ্দ পাওয়ার পর সরকার এটিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে তালিকাভুক্ত করে। এরপর জহিরা সেটেলমেন্ট আদালতে মামলা করেন। আদালত তাঁর পক্ষে রায় দেন। সরকার এরপর হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করে। হাইকোর্টও ১৯৯৭ সালে জহিরার পক্ষে রায় দেয়। আদালত সরকারকে দ্রুত রায় বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন।
কিন্তু সরকার রায় বাস্তবায়ন না করায় জহিরা আবার হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। হাইকোর্ট আবারও জহিরার পক্ষে রায় দেয় এবং ৬০ দিনের মধ্যে সম্পত্তি হস্তান্তরের নির্দেশ দেয়। এরপর জহিরা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলে মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করেনি।
২০০৮ সালে জহিরা হাইকোর্টে কনটেম্পট মামলা করেন। ২০১০ সালে আদালত রায় দ্রুত বাস্তবায়নের আদেশ দেন। এরপর জহিরা ও এম এ মোতালেব গণপূর্তের আইন উপদেষ্টার কাছে গেলে বিভিন্ন যাচাই-বাছাইয়ের পর ঘুষ দাবি করা হয়। ঘুষ না দেওয়ায় ২০১৬ সালে মন্ত্রণালয় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে।
এম এ মোতালেব বলেন, "মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা আদালতের আদেশ অনুযায়ী পরিচয় যাচাইয়ের পর আমাদের কাছে ৮-১০ কোটি টাকা ঘুষ দাবি করেন। কিন্তু এ টাকা না দেওয়ায় তারা প্লট বুঝিয়ে না দিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। এখন আপিল শুনানি চললেও সেখানে ভবন নির্মাণ চলছে। আর এই ভবনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, মন্ত্রীদের স্বজনকে ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে। বিচারপতিদের ফ্ল্যাট দিয়েছে মন্ত্রণালয়।"
জহিরা ওসমান শেখ বলেন, "১৪ বছর ধরে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। তবুও নিজের ন্যায্য জমি বুঝে পাচ্ছি না। আদালত আমার পক্ষে রায় দেওয়ার পরও জমির মালিকানা পাচ্ছি না। ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা আমার প্লটে নিজেদের আলিসান ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করে নিয়েছে। এখন আদালতের আদেশ অমান্য করে আমার জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করছে।"
সরেজমিনে দেখা যায়, ৩২ কাঠা আয়তনের প্লটটিতে রাজউকের রূপসা অ্যাপার্টমেন্টের ১৫ তলা ভবনের কাজ চলছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া ভবনটির এখন ১৪ তলা ছাদের কাজ চলছে। রূপসা অ্যাপার্টমেন্টের প্রকল্প পরিচালক জানান, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হবে।
রাজউক সূত্র জানায়, রূপসা প্রকল্পে তিন হাজার বর্গফুটের ৪৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণ হবে। গত বছর লটারির মাধ্যমে পাঁচটি ফ্ল্যাট মন্ত্রণালয় ও সরকারের কাছে রেখে বাকি ৪৩টির লটারি অনুষ্ঠিত হয়।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক বলেন, বিচারাধীন সম্পত্তিতে কীভাবে অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছে, সেটি তাঁর জানা নেই। তবে নিয়ম না মেনে অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি সম্ভব নয়। তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা জানান।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আইন উপদেষ্টা বলেন, প্লটটি সম্পর্কে তাঁর কাছে তথ্য নেই। তবে কাগজপত্রসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাধ্যমে এলে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।