মঙ্গলবার, ১লা জুলাই, ২০২৫| রাত ১২:৩৫

বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ: স্বীকৃতি বড়, চ্যালেঞ্জও ততই বড়

প্রতিবেদক
staffreporter
জুন ২৬, ২০২৫ ৯:১৬ পূর্বাহ্ণ
বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ: স্বীকৃতি বড়, চ্যালেঞ্জও ততই বড়

বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ: স্বীকৃতি বড়, চ্যালেঞ্জও ততই বড়

২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ করে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করবে। জাতিসংঘ ইতোমধ্যে এই উত্তরণের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। তবে দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, বাস্তবতা কঠিন, কাঠামোগত দুর্বলতা, বৈষম্য, প্রস্তুতির ঘাটতি ও আমলাতান্ত্রিক ধীরগতি বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদার সুফল পেতে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ও তার চ্যালেঞ্জ

উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়া মানে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে সামগ্রিক উন্নতি অর্জন। এটি দেশের জন্য গর্বের বিষয় হলেও এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক কিছু সুবিধা হারানোর বিষয়টি জড়িত। যেমন- ইউরোপ, কানাডা ও জাপানসহ বড় বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশ, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ আইনে ছাড়, বাণিজ্য সহায়তা এবং অনুদানমুখী ঋণ সুবিধা থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতা।

এই সুবিধাগুলো হারানোর ফলে বাংলাদেশকে তার রফতানি খাতকে আরো প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে, রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে এবং নতুন বাজার উন্মোচন করতে হবে।

উদ্বেগের কারণসমূহ

১. রফতানির একপেশে নির্ভরতা: বাংলাদেশের মোট রফতানির প্রায় ৮০% আসে গার্মেন্টস খাত থেকে। অন্যান্য খাত এখনও পর্যাপ্তভাবে গড়ে উঠেনি।

২. অনির্দিষ্ট শুল্কনীতি: বাংলাদেশ এখনও স্পষ্ট ও সমন্বিত শুল্কনীতি প্রণয়ন করতে পারেনি, যা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার কারণ হতে পারে।

৩. অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত দুর্বলতা: উৎপাদনশীলতার কমতি, দক্ষ জনশক্তির অভাব, প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও ঋণ চাপ বাড়ছে।

৪. বৈষম্য ও মূল্যস্ফীতি: মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেলেও আয়ের অসম বণ্টন ও মূল্যস্ফীতি জনজীবনকে বিপন্ন করছে।

উত্তরণের পরে সম্ভাব্য পরিস্থিতি

উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ হতে পারে। অন্যান্য অনেক দেশের মত বাংলাদেশও যদি এখন থেকেই প্রস্তুতি না নেয়, তবে এই মর্যাদা কেবল একটি প্রতীক হিসেবে থাকবে, আর বাস্তবে মানুষের জীবনযাত্রায় তা বিশেষ প্রভাব ফেলবে না।

সরকারের প্রস্তুতি

সরকার ‘স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি’ গ্রহণ করেছে, যার মাধ্যমে নতুন বাজার অন্বেষণ, রফতানি বৈচিত্র্য, রাজস্ব বৃদ্ধিসহ ব্যবসা পরিবেশ সহজীকরণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা হবে। তবে বাস্তবায়নে দেরি ও ঘাটতি রয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা উল্লেখ করছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

  • বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেছেন, দেশের অর্থনীতিতে অগ্রগতি থাকা সত্ত্বেও পুরোপুরি প্রস্তুত নয়; উত্তরণ কয়েক বছর পিছিয়ে নিলে ভালো হত।
  • তিনি শিল্প খাতের বিকেন্দ্রীকরণ এবং রাজধানীভিত্তিক উৎপাদন কাঠামো পরিবর্তনের গুরুত্বও তুলে ধরেছেন।
  • সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলছেন, রফতানি খাতসহ আন্তর্জাতিক সুবিধা হারানোর ফলে বছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির ঝুঁকি রয়েছে।
  • তিনি আরও সতর্ক করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অনুদানও কমে আসতে পারে।

অর্থনৈতিক তথ্যের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন

ড. ফাহমিদা খাতুন গত সরকারের সময়ে প্রকাশিত অর্থনৈতিক তথ্যগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বাস্তবতা থেকে দূরে বলে মন্তব্য করেছেন।

দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা যা দ্রুত ও কার্যকর বাস্তবায়নের দাবি রাখে। তিনি একটি ‘অগ্নিনির্বাপক দল’ গঠনের আহ্বান জানান, যারা যেকোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত সাড়া দিতে পারবে এবং সমস্যা সমাধানে কাজ চালিয়ে যাবে।

অগ্রাধিকার পদক্ষেপ

উত্তরণ কার্যক্রমে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নির্ধারণ করা হয়েছে:

১. জাতীয় সিঙ্গেল উইন্ডো পুরোপুরি চালু করা,
২. জাতীয় শুল্ক নীতি ২০২৩ বাস্তবায়ন,
৩. জাতীয় লজিস্টিকস নীতি ২০২৪ অনুযায়ী অবকাঠামো উন্নয়ন,
৪. সাভার ট্যানারি ভিলেজে ইটিপি স্থাপন ও চালু রাখা,
৫. গজারিয়ায় এপিআই পার্ক চালু করে ওষুধ খাত শক্তিশালী করা।

ড. ইউনূস বলছেন, এই পদক্ষেপগুলো রুটিন নয়, বরং উত্তরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দ্রুত বাস্তবমুখী কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন।


বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ একটি গৌরবময় অর্জন হলেও এর সুফল পুরোপুরি পেতে হলে দ্রুত ও কার্যকর প্রস্তুতি ও কাঠামোগত সংস্কার অপরিহার্য। নইলে এই মর্যাদা কেবল কাগজেই থেকে যাবে, মানুষের জীবনযাত্রায় তা কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনবে না।

মন্তব্য করুন
Spread the love

সর্বশেষ - বানিজ্য ও অর্থনীতি